উল্টো করে লাগানো ছিল ইঞ্জিন, আগেই জানানো হয়েছিল দুর্ঘটনার শঙ্কা
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০১:২৫
উল্টো করে লাগানো ছিল ইঞ্জিন, আগেই জানানো হয়েছিল দুর্ঘটনার শঙ্কা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

অনেকদিন ধরেই নষ্ট ছিল ঢাকার লোকোশেডে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র (টার্ন টেবিল)। ফলে মালবাহী ট্রেনটির ইঞ্জিন উল্টো লাগিয়ে চালানো হতো। এর ফলে চালকের সিগন্যাল দেখতে সমস্যা হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে টার্ন টেবিল দ্রুত মেরামতের তাগিদ দিয়ে রবিবার (২২ অক্টোবর) ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (লোকো) চিঠি দেয়া হয়।


ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (লোকো) রেলের চট্টগ্রামের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) সাজিদ হাসান নির্ঝর স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, ঢাকার লোকোশেডের টার্ন টেবিলটি নষ্ট। তাই লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ঘোরানো সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণে ২৬০০, ২৯০০ এবং ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো পেছনের দিক সামনে রেখে ট্রেন চালাতে হয়। অনেক স্থানে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিগন্যাল এবং লেভেল ক্রসিং দেখা যায় না।


চিঠিতে টার্ন টেবিলটি দ্রুত মেরামত করার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, বিশেষ করে ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যেকোনো সময়ে সিগন্যাল ওভারশ্যুট বা লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।


এই ঘটনার একদিন পর সোমবার (২৩ অক্টোবর) ভৈরব স্টেশনের আউটারে যাত্রীবাহী এগারোসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসে উল্টো ইঞ্জিনের মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ২৩ জন নিহত হয়েছেন।


তবে এ বিষয়ে রেলওয়ে বলছে, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী মালবাহী ট্রেনের চালকের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটেছে।


রেলের পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনটিকে স্টেশনে আউটারে থামতে সিগন্যাল দেওয়া হয়। ট্রেনটির লোকো মাস্টার (চালক) সংকেত অমান্য করে স্টেশনে ঢুকে পড়ায় ভৈরব থেকে ঢাকামুখী যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষের তিনটি বগির সঙ্গে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কা লাগে।


রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, শুধু চালকের ভুলের নয়, রেলেরও গাফিলতি রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ৩০২৮ নম্বরের ইঞ্জিনে মালবাহী ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালক জাহাঙ্গীর আলম। ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগ দেয়া এই চালক গত ছয় বছর পণ্যবাহী ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে।


রেল সূত্রের ভাষ্য, উল্টো ইঞ্জিনের কারণে ভৈরবের দুর্ঘটনায় একই সমস্যা ছিল। চালকের বরাতে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, লং হুড সমস্যায় আউটারে থামার সিগন্যাল দেরিতে দেখেন। ব্রেক করতে দেরি হওয়ায় মালবাহী ট্রেনের গতি কমলেও, থামেনি।


রেলের আরকটি সূত্রের দাবি, মালবাহী ট্রেনের বগির ডিস্ট্রিবিউটর ভাল্ব (ডিভি) কাজ করেনি। চালক ইঞ্জিনের ব্রেক করলেও, ডিভি কার্যকর না থাকায় বগির ব্রেক কাজ করেনি। তাই ট্রেনটি থামেনি। ৩২ বগির চারটির ডিভি সচল পাওয়া গেছে দুর্ঘটনার পর। তবে এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।


এদিকে একাধিক রেল কর্মকর্তার ভাষ্য, চালকেরও ভুল রয়েছে। ভৈরব স্টেশনটি চট্টগ্রামমুখী রেললাইন থেকে নিচু। তাই স্টেশনে প্রবেশের আগে সতর্কতা হিসেবে গতি কমাতে হয়। কিন্তু চালক জাহাঙ্গীর আলম তা করেননি। আর সিগন্যাল বাতি থাকে বাম দিকে। ইঞ্জিন উল্টো করে চালালে চালকও থাকেন বাম দিকে। ফলে সিগন্যাল দেখতে না পাওয়ার কারণ নেই। বড়জোর ৫০ ফুট পর দেখতে পান।


অপরদিকে দুর্ঘটনার পর চালক, সহকারী লোকো মাস্টার ও গার্ডকে সাময়িক বরাখাস্ত করেছে রেলওয়ে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উল্টো ইঞ্জিনের বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান সমকালকে বলেছেন, কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তে জানা যাবে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।


এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভৈরব বাজার ফায়ার স্টেশনের ফাইটার মোশাররফ। তিনি জানান, দুর্ঘটনাকবলিত এগারোসিন্ধুর গোধুলীর তিনটি বগি থেকে একে একে মরদেহ বের করা হচ্ছে। বগির নিচে অনেকে চাপা পড়েছেন। তাদের উদ্ধারে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।


এদিকে এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে উদ্ধারকাজ শুরু করছেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এতে হতাহতের সংখ্যা শতাধিক হতে পারে বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এক খুদে বার্তায় এ আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে।


রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা থেকে একটি কনটেইনারবাহী ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করছিল। তার আগ মুহূর্তে ভৈরব থেকে এগারোসিন্দুর ট্রেন ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিল। জগন্নাথপুর রেলক্রসিং এলাকায় এগারোসিন্দুর ট্রেনের শেষের দুই-তিনটি বগিতে কনটেইনারবাহী ট্রেন আঘাত করে। মূলত সিগনালিংয়ের কোনো জটিলতার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।


ভৈরব বাজার ফায়ার স্টেশনের ফাইটার রাসেল বলেন, আমরা বিকেল ৪টার দিকে দুর্ঘটনার খবর পাই। হতাহতদের উদ্ধারে ঘটনাস্থলে কাজ করছেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দুর্ঘটনায় কতজন নিহত হয়েছেন তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়েছেন। আরও হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com