ইলিশের বাজারে আগুন, অথচ বদলায় না জেলেজীবন!
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৫
ইলিশের বাজারে আগুন, অথচ বদলায় না জেলেজীবন!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

কথায় আছে, মাছের রাজা ইলিশ। সুস্বাদু এই রাজা মাছের দাম একটু বেশিই হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপত্তি উঠেছে তখনই যখন এ মাছ ধরার মূল কারিগর অর্থাৎ জেলেরা এ মাছের ন্যায্য মূল্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।



সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে জেলেরা ইলিশ শিকার করলেও আড়তদার, মহাজনসহ নানা সিন্ডিকেটের কাছে নিজেরাই যেন শিকার হয়ে যাচ্ছেন। এ শিকার শোষণের, এ শিকার বঞ্চনার। এ নিয়ে জেলেদের চাপা ক্ষোভ থাকলেও নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন তারা।



তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বিশেষ করে পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, পাথরঘাটা এলাকায়,চাঁদপুরে, ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, হাতিয়ার বুড়িরচর, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী, মিরসরাই, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ ও সীতাকুণ্ডের উপকূল এলাকায় ইলিশ ধরা পড়ছে। তবে মৌসুমের শেষের দিকে এসে এসব এলাকায় ইলিশের যোগান থাকলেও জেলেরা পাচ্ছেন না ন্যাযা মূল্য। ফলে মাছ ধরার সময় তারা হাসিমুখে থাকলেও বিক্রির সময় মলিন হয়ে যায় তাদের চেহারা। আড়তদার, মহাজনসহ আরও নানা সিন্ডিকেটের কারণে মাছের প্রকৃত দাম হাঁকাতে পারেন না তারা।



সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, এখানে ইলিশের দাম নির্ভর করছে সাইজের উপর। ২ কেজি সাইজের উপরের ইলিশগুলোর কেজি ২৫০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। ১ কেজি ৩০০/৪০০ গ্রামের সাইজ কেজি ১৮০০ টাকা, ১ কেজি ২০০ গ্রামেরগুলো ১৬০০/১৭০০ টাকা, ১ কেজি সাইজ ১২০০ /১৩০০ টাকা, ১ কেজিতে ৬ টা ধরবে এমনগুলো ৭০০ টাকা এবং তার চেয়ে ছোট সাইজ ৫০০/৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।



তবে জেলেরা বলছেন, বাজারে যে দামে ইলিশ বিক্রি হয় সে দাম তারা পান না। তারা মাছ বিক্রি করেন গড়পড়তা হিসাব করে। বাজারে যেভাবে কেজি দরে মাছ বিক্রি করা হয়, তাদেরকে সে দাম দেয়া হয় না।


বঙ্গোপসাগরে তীরবর্তী সন্দ্বীপের জেলে মোহন লাল বিবার্তাকে বলেন, ইলিশ মাছ ধরার জন্য জাল তৈরি করা, নৌকা তৈরি করাসহ আরও নানা খাতে আমাদের নদীতে নামার আগে অনেক খরচ করতে হয়। ফলে দরিদ্র জেলেরা এসব খরচ জোগাতে হাত পাততে হয় মহাজন,আড়তদারদের কাছে। অনেক কঠিন শর্তের বিনিময়ে তারা জেলেদের টাকা দেয়। ফলে জেলেরা তাদের কাছে অসহায় হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এসব কারণে আমরা ন্যায্য মূল্য পাই না।



ক্ষোভ প্রকাশ করে এ এলাকার শিমুল দাস নামের আরেক জেলে বিবার্তাকে বলেন, উত্তাল সমুদ্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা ইলিশ মাছ ধরি। অনেক সময় আমাদের অনেকে ঢেউয়ের তলে একেবারে চিরতরে হারিয়ে যায়। এতো কষ্টের পরও আমরা সঠিক দাম পাই না,কিছু বলতেও পারিনা! ফলে অভাব লাঞ্চলায় আমাদের দিন কাটে।


ঢাকায় ১ কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১২০০/১৩০০ টাকা, এটা জানানো হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, বাবা- এসব জেনে আমাদের লাভ কী? আমরা তো এর ধারে কাছেও পাই না!


রতন মিয়া নামের আরেকজন আক্ষেপ করে বিবার্তাকে বলেন, অনেক সময় সরকার ইলিশ ধরতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে আমরা কিছু মনে করি না। কারণ এই সময় ইলিশের পোনা ছাড়ে। কিন্তু এসময় আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রণোদনা দেয়া হয় তা আমাদের অনেকে পাই না। আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।


খোঁজ নিয়ে জেলেদের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। ইলিশকে ঘিরে আড়তদার,মহাজন থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরা জেলেদের থেকে নানা ফন্দিফিকির করে, এমনকি হুমকি-ধমকি দিয়ে তুলনামূলক সস্তায় মাছ কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করছেন। ফলে জেলেরা বঞ্চিত হলেও এ সিন্ডিকেট ঠিকই অধিক মুনাফা করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করছেন।


বিবার্তার সাথে কথা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইলিশের আড়তদার আবদুল মালেকের সাথে। তিনি বলেন, আমাদের কিনতে হয় বেশি দামে। তাই আমরা কেনা দাম বিবেচনায় অল্প লাভ করে বিক্রি করে থাকি।



ইলিশ মাছ ঘিরে সিন্ডিকেট হয়ে যাওয়ায় দাম বেশি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখেন-আমরা বেশি লাভ করি না। কারা বেশি লাভ করে, সিন্ডিকেট কী? এসব কিছুই জানি না, বুঝি না।


এই বাজারের আরেক আড়তদার মো. মহসীন বিবার্তাকে বলেন, আমরা তো সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনি না। তারা ন্যায্য মূল্য পায় না, সেটা আমরাও জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে তো আমাদের কিছুই করার নেই। তারা মহাজনদের কাছ থেকে কড়া সুদে টাকা নিয়ে অনেকক্ষেত্রে জিম্মি হয়ে আছে।


সন্দ্বীপের এক জেলে মারফত নাম্বার পেয়ে যোগাযোগ হয় এই এলাকার মহাজনের সাথে। নজরুল ইসলাম নামের এই ব্যক্তি বিবার্তাকে বলেন, আমরা জেলেদের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করি। কোনভাবে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করি না।


মাছ বিক্রিতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলেরা নিজেদের ইচ্ছে মতো দাম হাঁকায়। আপনি চাইলে এসে দেখে যেতে পারেন।


বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা জি এম মাসুদ শিকদার মুঠোফোনে বিবার্তাকে বলেন, ইলিশ আহরণ নিয়ে জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটই যেন ভারী হয়। এদিকে গরিব জেলেদের কোনো ভাগ্য উন্নয়ন হয় না। মাছের দাম নিয়ন্ত্রণও সম্পূর্ণভাবে আড়তদারদের হাতে থাকে। এটা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।


ইলিশের ন্যায্য মূল্য জেলেরা না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানী আতিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যে ইলিশ দেশের অর্থনীতিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিচ্ছে সেই ইলিশ ধরার মূল কারিগররা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এটা খুবই অমানবিক, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা। এক শ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী সিন্ডিকেট সৃষ্টি হওয়ায় জেলেরা কঠিন শর্তারোপ, হুমকি-ধমকির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে বছরের পর বছর শোষণের শিকার হচ্ছেন।


তিনি বলেন, সরকার সার্বিক পরিস্থিতিতে জেলেদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিলেও অনেক সময় তারা না পাওয়ার অভিযোগও আসছে। এ বিষয়ে কঠোর সতর্কতা আরোপ করে মুনাফালোভীদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। প্রয়োজনে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।


এ মৎস্য বিজ্ঞানী বলেন, আমাদের জাতীয় অমূল্য সম্পদ মৎস্য খাতকে টিকিতে রাখতে জেলেদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করার কোনো বিকল্প নেই।


এই বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বিবার্তাকে বলেন, ইলিশ বা যেকোনো পণ্যের দাম কত হবে, সেটা বাজারই ঠিক করে। এটা জেলের চাহিদা, উৎপাদন ও আহরণের কস্টের উপর নির্ভর করে। আমি কোন পক্ষ নিয়ে কথা বলছি না। এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা আমার, আপনার কাজও না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে ভোক্তা, বিক্রেতা ও উৎপাদকরা।


উল্লেখ্য, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ, জেলেদের ঘামঝরা পরিশ্রমের ফলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে অবদানসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় ও আমিষ সরবরাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ইলিশ। পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতিও এসেছে দেশে। জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযানসহ সরকারের নানামুখী কঠোর ব্যবস্থাপনায় গত এক যুগে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ টন। হতাশার বিষয় এটিই, ইলিশ ধরার কারিগরদের বঞ্চিত হওয়া।


এদিকে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে আগামী ১২ অক্টোবর থেকে সারা দেশে ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার সময় আরও ১ মাস পেছানোর দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বরিশালের জেলে আড়তদারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com