ডেঙ্গুতে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট, দাম দ্বিগুণের বেশি
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১২
ডেঙ্গুতে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট, দাম দ্বিগুণের বেশি
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীর জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৪ বার ডায়ালাইসিস করার পর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ১৪ বছর বয়সী ছেলে জিহাদ ও তার মা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তিন দিন পর পর ডায়ালাইসিস করতে হয়। ১০ সেপ্টেম্বর, রবিবার সকালে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের সময় সব সময়ের মতো রক্ত ও স্যালাইন দরকার হয়। কিন্তু রক্ত পাওয়া গেলেও স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছিল না।


হাসপাতালের ফার্মেসিতে স্যালাইন নেই, হাসপাতালের সামনের ফার্মেসিসহ আশপাশের এলাকায় খোঁজ করেও ইনজেক্টেবল স্যালাইন পায়নি সে। পরে শাহবাগ ও আসপাশের কয়েকটি দোকান ঘুরে তিন ব্যাগ স্যালাইন নিয়ে আসেন জিহাদ।


শুধু জিহাদের বাবা নন, স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নিয়মিত। গত কয়েক মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো তীব্র স্যালাইন সংকটে ভুগছে। তবে সম্প্রতি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকট কাটলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ও বাজারের সংকট এখনও কাটেনি। এ কারণে দামও বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ।


স্যালাইনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং এর দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার মনিটরিংয়ের আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ ও ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা।


চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণ স্যালাইন শুধু ডেঙ্গুই না সিজার, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের সংকটে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।


দেশে স্যালাইনের ব্যবহার ব্যাপক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্যালাইনের ব্যাপক ব্যবহার সংঘবদ্ধ চক্রকে বিরাট এক সুযোগ এনে দেয়। ডেঙ্গু রোগীর রক্তের ঘনত্ব ঠিকঠাক রাখার জন্য স্যালাইন প্রদান করা হয়। গত মাস দুয়েক ধরে দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। আর এই সুযোগে দেশব্যাপী স্যালাইনের সংকট তৈরি হয়।


দেশে একাধিক ওষুধ কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। সাধারণ এসব স্যালাইনের বাজার মূল্যও খুব বেশি নয়। আধা লিটার স্যালাইন ৪৫/৫০ টাকা এবং এক লিটারের স্যালাইন ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হতো। স্যালাইনের গায়ে এই মূল্য আরো কম লেখা রয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গুর রোগের বিস্তারে হঠাৎ করে এই স্যালাইনের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এক লিটার স্যালাইন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। টাকা দিয়েও স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না ফার্মেসিগুলোতে। একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের কোথাও স্যালাইন নেই।


মো. নজরুল ইসলাম বলেন বিবার্তাকে বলেন, আমার স্ত্রী অসুস্থ সে হাসপাতালে ভর্তি আছে, তাকে স্যালাইন দিতে হবে। হাসপাতালের ফার্মেসিতে স্যালাইন নেই। তাই বাইরে থেকে ডাক্তার স্যালাইন কিন আনতে বলেছে। তার জন্য স্যালাইন কিনতে এসেছি। প্রায় সব দোকানে খুঁজছি, কিন্তু কোন ফার্মেসিতে পাচ্ছি না।


মিরপুর থেকে শাহবাগ এসেছেন মায়ের জন্য স্যালাইন কিনতে মো. রাশেদুল ইসলাম। কথা হয় তার সাথে তিনি বিবার্তাকে বলেন, মিরপুরে প্রায় সব দোকানে ঘুরে দুটি স্যালাইন পেয়েছি, দাম অনেক বেশি। আমার আরো দুটি স্যালাইন দরকার। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। দোকানদাররা বলছে সরবরাহ কম তাই স্যালাইন বাজারে নেই।


একাধিক ফার্মেসি মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইনের সরবরাহও কমে গেছে। ১০০টি স্যালাইন চাইলে ১০-২০ টি দিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের জানিয়েছেন বর্তমানে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি। এ কারণে স্যালাইনের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে ফার্মেসিতে সাধারণ স্যালাইনের এক কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।


রাজধানীর শাহবাগ ঢাকা ফার্মেসির মালিক মো. হাসানুল বারী বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো বলছে, সরবরাহ সংকটের কারণে কোম্পানীগুলো স্যালাইন আমাদের দিতে পারছে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো স্যালাইন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০টি স্যালাইন চাইলে ৫ থেকে ১০টি দিচ্ছে। প্রতিদিন অসংখ্য রোগীরা স্যালাইন কিনতে আসছে। আমাদের কাছে না থাকার কারণে আমরা বিক্রি করতে পারছি না।


রাজধানীর কলেজ গেট মেডিকেয়ার ফার্মেসির কামরুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, সারাদেশে বর্তমানে খুবই সংকট স্যালাইনের। দুই মাসের বেশি সময় ধরে অর্ডার দিয়েও বেক্সিমকোর স্যালাইন পাচ্ছি না। প্রতিদিন দুই শতাধিক ব্যাগের চাহিদা থাকলেও পাচ্ছি না। অন্যান্য কোম্পানি থেকে সপ্তাহে দু’দিন কিছু ব্যাগ করে স্যালাইন পাচ্ছি। যা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। শুধু ডেঙ্গু নয়, অন্যান্য রোগীর স্বজনও স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।


রাজধানীর পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ফার্মেসির ফজলে হাসান বিবার্তাকে বলেন, বাজারে স্যালাইনের সংকটকে কাজে লাগিয়ে একটি মহল প্রচুর দামে স্যালাইন বিক্রি করছে। একেবারে অনৈতিকভাবে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। ডেঙ্গু রোগের বিস্তারে হঠাৎ করে এই স্যালাইনের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এক লিটার স্যালাইন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে রোগীদের চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে ভোগান্তিও বাড়ছে।


এ নিয়ে ধানমণ্ডি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের চিকিৎসক মনিরুল ইসলাম মিঠু বিবার্তাকে বলেন, নরমাল স্যালাইন শুধু ডেঙ্গু নয়; গাইনি, সার্জারি সব ক্ষেত্রে প্রয়োজন। এখন যে হারে স্যালাইনের চাহিদা, সেই তুলনায় কোম্পানি থেকে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কোম্পানিতে ১০০ ব্যাগ চাহিদা দিলেও, তুলনামূলক কম দেওয়া হচ্ছে। আগে মিটফোর্ড মার্কেট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন কিনা যেতো। এখন প্রতিদিন তিন-চারজনকে সেখানে পাঠিয়েও ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও ৯০-৯৫ টাকার স্যালাইন কিনতে হচ্ছে ২০০ টাকা ব্যাগ। এতে রোগীদের চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে ভোগান্তিও বাড়ছে।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বিবার্তাকে বলেন, স্যালাইন বানাতে বিদেশি কোন কাঁচামাল দরকার হয় না। দেশেই বানানো যায়, শুধু লবন আর পানি। আমাদের ব্যবসায়ীরা যদি এ সমস্ত আচরন করা শুরু করে এবং সামনে নির্বাচন বলে মনে করে সরকার এখন কিছু বলবে না। এটাতো খুবই অমানবিক কাজ।


তিনি বলেন, কিছুই তো লাগে না স্যালাইন বানাতে। কোনো কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয় না। সবই বাংলাদেশে পাওয়া যায়, লবণ আর পানি। আর কোন কোন স্যালাইনে গ্লুকোজ দেওয়া থাকে।


আ ব ম ফারুক বলেন, প্রোডাক্টশন ঠিকমতই হচ্ছে আরো বেশি প্রোডাক্টশন হচ্ছে। কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কারণ এখন ডেঙ্গু বেড়েছে। ডাক্তাররা ডেঙ্গুর কারণে স্যালাইন পুশ করছেন। যে কারণে মানুষজন অনেক স্যালাইন কিনছে, তার কারণে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে লোকজন মরে যাক, তাদের কোন অসুবিধা নেই। আমার ব্যবসা হলেই হল। এ যে অপমানুষিকতা এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যে যার মতো লুট করবে। যে যার মত দাম নিবে এটা ঠিক না।


তিনি বলেন, আপনার মনে আছে করোনার সময় প্যারাসিটামল পাওয়া যাচ্ছিল না। কেন? প্যারাসিটামল কি আকাল পড়েছিল, না। ঠিক তেমনি এখন স্যালাইন নেই অযথা কৃত্রিম সংকট!


সরকার এসব নিয়ে আন্তরিক রয়েছে তবে সরকারি অফিসে যারা কর্মরত বা কর্তব্যরত আছেন তারা যদি এসব বিষয়ে তৎপর না হন তারা যদি একটু বুদ্ধি খরচ না করেন তাহলে এই ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সংকটের নামে এমন আচরণ করতেই থাকবে বলে জানান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।


এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আব্দুল্লাহ্ বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাড়ার সাথে সাথে বাজারে স্যালাইন থেকে শুরু করে ফল-মূল, লেবু, ডাবের দাম পর্যন্ত বাড়িয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যারা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অধিক লাভের আশায় এসব কাজ করছেন। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে করছেন প্রতারণা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে।


তিনি বলেন, সরকার এ নিয়ে বিভিন্ন অধিদপ্তরে নানা দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু যারা বাজার মনিটরিং করেন তাদের উচিত এসব সিন্ডিকেটের মুখোশ খুলে দেওয়া। এসব নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা যদি এসব বিষয়ে তৎপর না হন তাহলে এর ভয়াবহতা আরো বাড়তে থাকবে।


স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বিবার্তাকে বলেন, সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেশিরভাগ রোগীদের চিকিৎসা দিতে স্যালাইন প্রয়োজন হচ্ছে। যাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা স্যালাইনের দাম বেশি নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহন করছি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।


এ নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুল আলম বিবার্তাকে বলেন, কিছুদিন আগে স্যালাইনের সংকট দেখা দিলে কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বাড়াতে বলা হয়েছিল। তাদের সাথে কথা বলে ছুটির দিনেও কারখানা খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যাতে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ করা যায়। আমার জানা মতে, এখন স্যালাইনের কোনো সংকট নেই।


ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বেশি নিচ্ছে। আশা করছি কিছুদিনের মধ্য এ সংকট কেটে যাবে।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com