বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরেছে, হলমুখী দর্শক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৯:২৬
বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরেছে, হলমুখী দর্শক
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা চলচ্চিত্রের দিন শেষ হয়ে গেছে! ভালো সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না! হলগুলো দর্শকশূন্য! দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে শুধু সংকট আর সংকট। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরাসহ বাংলা সিনেমার দর্শকদের মনে এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল দীর্ঘদিন। অথচ একটা সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ছিল আশা জাগানিয়া। তখন সিনেমা মুক্তি মানেই উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনায় মুখরিত সিনেমা হল। সেই দিন যেন ক্রমেই অতীত হচ্ছিল। তবে একটু বেশি সময় লাগলেও সেই অতীত আবার ফিরে এসেছে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে। নিকট অতীতে সিনেমা মুক্তি পেলেও দর্শক প্রায় সিনেমা হলে যাওয়াই ভুলে গিয়েছিল। আর এখন হলগুলোতে তার উল্টো দৃশ্য। দর্শক সিনেমা হলে যাচ্ছে, তাও আবার দলবেঁধে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু কিছু সিনেমার টিকিট পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বাংলা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো মানের সিনেমা নির্মাণ হওয়ায় চলচ্চিত্র প্রেমী মানুষ হলমুখী হয়েছে। আর তার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরেছে। হারাতে বসা চলচ্চিত্রের সফলতার এই ধারা ধরে রাখতে দর্শক চাহিদার বিষয় মাথায় রেখে ভালো সিনেমা বানানোর কোন বিকল্প নেই বলে জানান তারা।


তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, গত ঈদুল আযহায় হিমেল আশরাফ পরিচালিত ‘প্রিয়তমা’, রায়হান রাফির ‘সুড়ঙ্গ’, সৈকত নাসির পরিচালিত ‘ক্যাসিনো’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’ ও বন্ধন বিশ্বাস পরিচালিত ‘লাল শাড়ি’ সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এরমধ্যে ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান অভিনীত ‘প্রিয়তমা’ ও ছোটপর্দার তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশোর সুড়ঙ্গ সিনেমাটি দর্শক চাহিদার তুঙ্গে রয়েছে। এই দুই সিনেমা দেখতে হলগুলোতে সিনেমাপ্রেমীদের ঢল নেমেছে। চাহিদামাফিক টিকিট না পেয়ে অনেককে সিনেমা দুটো দেখতে হয়েছে অপেক্ষার প্রহর গুণে- যা বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক অনন্য মাইলফলক। এদিকে ঈদের পর ইতোমধ্যে পাঁচ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশের সিনেমাহলগুলোতে এই দুই সিনোমার দাপট চলছে। দেশের সর্ববৃহৎ মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্সে হলিউড মুভির শো কমিয়ে দেশি এই ‍দুই সিনেমার শো বাড়ানো হয়েছে- যা অনন্য নজির।


শুধু তাই নয়, ‘প্রিয়তমা’ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, আবুধাবি, বাহরাইন, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, ভারত ও সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশেও মুক্তি পেয়েছে। সেখান থেকে ভালো ব্যবসার খবরও গণমাধ্যমে আসছে। অন্যদিকে ‘সুড়ঙ্গ’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তি পায়। এই মুভিটিরও নিয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ইতিবাচক গুঞ্জন উঠেছে।


তথ্য বিশ্লেষণে আরো জানা যায়, প্রিয়তমা সিনেমায় প্রথমবারের মতো বয়স্ক চরিত্রে দেখা গেছে শাকিব খানকে, যা তার ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম। চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যটি দর্শক মহলে খুব প্রশংসিত হয়েছে। সিনেমায় শাকিবের বিপরীতে অভিনয় করেছেন কলকাতার ইধিকা পাল। এ ছাড়া আরও অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শহিদ-উন নবী প্রমুখ। এদিকে ‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আফরান নিশোর বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে। নিশোর বিপরীতে অভিনয় করেছেন তমা মির্জা৷ মাসুদ চরিত্রে নিশোর অনবদ্য অভিনয় দর্শক মনে দাগ কেটেছে।


‘প্রিয়তমা’ সিনেমা সফল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্মাতা হিমেল আশরাফ বিবার্তাকে বলেন, ‘প্রিয়তমা’ মুভিটি ইতোমধ্যে ব্লকবাস্টার হয়েছে। দর্শকের ভালোবাসায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি। এই মুভির সফলতা ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।


প্রিয়তমা ও সুড়ঙ্গ-এর দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার আগে হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ দুটি ছবি প্রায় সমান গতিতে ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে। এর আগে করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমা ছিল স্থবির। রায়হান রাফি পরিচালিত ‘পরাণ’ ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্র। মো. তামজিদ উল আলম লাইভ টেকনোলজিসের অধীনে প্রযোজনা করেছেন। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদ্যা সিনহা মীম, শরিফুল রাজ ও ইয়াশ রোহান। আর ‘হাওয়া’ একই বছরের বাংলা ভাষার রহস্যধর্মী চলচ্চিত্র, যেটি পরিচালনা করেছেন মেজবাউর রহমান সুমন। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষি, শরিফুল রাজ, সুমন আনোয়ার, সোহেল মণ্ডল, নাসির উদ্দিন খান ও রিজভী রিজু প্রমুখ।


২০২২ সালে ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’-এর সফলতার পর ২০২৩ সালে এসে ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুরঙ্গ’ সিনেমা দুটিও হিট হয়। ফলে সফলতার এই ধারাবাহিকতায় দর্শকদের হলমুখী হওয়ার বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গল্প ভালো হলে আর নিখুঁত অভিনয় হলে অবশ্যই সিনেমা হিট হবে। দর্শক মনে দাগ কাটা এই মুভিগুলোর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।


এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি ও বরেণ্য নির্মাতা কাজী হায়াৎ বিবার্তাকে বলেন, বাংলা সিনেমা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের সংবাদ, খুশির সংবাদ। এর আগেও আমি সংকটের সময় বলেছিলাম বাংলা সিনেমা আবার তার হারানো পথ খুঁজে পাবে। ঠিকই তাই হলো। গত ঈদের সিনেমাগুলোতে মানুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করেও হলে গিয়ে দেখেছে। ভালো গল্প ও ভালো মানের সিনেমা হলে দর্শক অবশ্যই হলে আসবে।


এই ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ভালো ভালো ছবি বানাতে হবে। সিনেমা হলে গিয়ে যাতে ভদ্র দর্শকরা দেখতে পারেন, সেই পরিবেশও তৈরি করতে হবে। চলচ্চিত্র সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য। এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।


চলচ্চিত্র পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার বিবার্তাকে বলেন, দর্শকের রুচি অনুযায়ী সিনেমা বানালে অবশ্যই দর্শক গ্রহণ করবে। গত ঈদের ছবিগুলোর গল্প ও ভালো মানের অভিনয়ের পারদর্শিতা ফুটে উঠেছে। এজন্য দর্শক আগ্রহ নিয়ে হলমুখী হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, দর্শকের এই আগ্রহ ধরে রাখার জন্য ভালো মানের সিনেমা, সিনেমা হলের সন্তোষজনক পরিবেশ ও হলের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।


বিশিষ্ট অভিনেতা তারিক আনাম খান বিবার্তাকে বলেন, ভালো ছবি, আধুনিক ছবি বর্তমান যুব সমাজ দেখতে চায়। কাজেই এই ধরণের ছবি হলে দর্শক আগ্রহ নিয়ে হলমুখী হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই ধারাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।


তিনি বলেন, আগামী ১১ আগস্ট আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘মাইক’ মুক্তি পাচ্ছে। আমার বিশ্বাস এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে চিনতে পারবে, জাগ্রত ইতিহাস জানতে পারবে। পুরো সিনেমাটি তাদের ভালো লাগবে।


অভিনেত্রী তানভীন সুইটি বিবার্তাকে বলেন, দর্শকদের হলমুখী হওয়া এটা সুখবর। আর আমি মনে করি যে মুভিগুলো দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে, সেগুলোর মতো কিংবা আরও ভালো মুভি যদি হয় তাহলে দর্শকরা অবশ্যই গ্রহণ করবে।



সুইটি অভিনীত ১১ আগস্ট মুক্তি পেতে যাওয়া ‘মাইক’ চলচ্চিত্র নিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, ৭৫’ পরবর্তী সময়ে দেশের যে নাজুক পরিস্থিতি হয়েছিল, এমনকি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল- সেইসব নানা দিক নিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র মাইক নির্মাণ করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিশুরা বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবে, একইসাথে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট হবে। কাজেই আমি মনে করি, অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের নিয়ে এই মুভিটি দেখা উচিৎ। এছাড়া ইতিহাস জানতে সকলের মুভিটি দেখা দরকার। আশা করি সবার ভালো লাগবে।


জনপ্রিয় অভিনেতা, নাট্য পরিচালক ও প্রযোজক কচি খন্দকার বিবার্তাকে বলেন, দর্শক হলমুখী হওয়া বাংলা চলচ্চিত্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য অসাধারণ বার্তা। বাংলা চলচ্চিত্রের একসময় খুবই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখলাম, চলচ্চিত্রকে ঘিরে একটা সংকট তৈরি হয়েছে, অনেকটা ধ্বংসযজ্ঞও বলা যায়। সেই কঠিন মুহূর্তে আমরা দেখলাম গত ঈদের কিছু মুভিসহ তার আগের কয়েকটি মুভি খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফলে দর্শকও আগ্রহ নিয়ে হলমুখী হয়েছে। একজন চলচ্চিত্র প্রেমী মানুষ হিসেবে এটা খুবই ভালো লাগার বিষয়।


তিনি বলেন, ভালো সিনেমা, চ্যালেঞ্জিং সিনেমা অবশ্যই দর্শক গ্রহণ করে। গত ঈদের সুরঙ্গ সিনেমার টিকিট আমি ৪ সপ্তাহ পরে পেয়েছি। এতে আমার ভোগান্তি হলেও এটা খুবই ভালো লাগার বিষয়। মানুষ হলে যাচ্ছে, সিনেমা দেখছে। অথচ এই চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা অনেকটাই অন্ধকারের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের সংশয় হচ্ছিল দর্শক আর হলে গিয়ে মুভি দেখবে কিনা? কিন্তু সেটাও আমরা কাটিয়ে উঠতেছি।


কচি খন্দকার বলেন, দর্শক চলচ্চিত্রের প্রাণ। কাজেই এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে আমার বিশ্বাস দর্শক অবশ্যই গ্রহণ করবে।


অভিনেতা নাদের চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ভালো গল্প, ভালো নির্মাণ আর সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো যদি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় অর্থাৎ এই তিনটা জিনিসের সমন্বয় হলে সিনেমা অবশ্যই হিট হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সফল সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।


তিনি বলেন, অনেকে বলেন- আমাদের দর্শকরা কেমন জানি হয়ে গেছে! হলে গিয়ে মুভি দেখতে চায় না। তবে এক্ষেত্রে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের। কাজেই দর্শকরা এখন সারাবিশ্বের সাথে সম্পর্কিত। তাদের রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের সিনেমাগুলো নির্মাণ করতে হবে। তাহলে অবশ্যই দর্শক গ্রহণ করবে।


বিবার্তা/ রাসেল/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com