নেই বাড়তি ভোগান্তি, স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১০:০২
নেই বাড়তি ভোগান্তি, স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

ঈদে পরিবার আর স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন নগরবাসী— অনেকেই। বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে বাড়ি ফিরতে এবার তেমন বাড়তি চাপ নেই, নেই ভোগান্তি। ফলে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা।


পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হবে মঙ্গলবার (২৭ জুন) থেকে। যদিও তার আগে থেকেই শুরু হয়েছে ঈদযাত্রায় মানুষের বাড়ি ফেরা। রাজধানীর বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনগুলোয় যাত্রী ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাভাবিকের চেয়ে যাত্রী সংখ্যা বেশি হলেও এখনো বাড়তি চাপ তৈরি হয়নি। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না যাত্রীদের।



রাজধানীর গুলিস্তান, কল্যাণপুরের দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার এবং আন্তঃজেলা তিনটি বাস টার্মিনাল যথাক্রমে যাত্রাবাড়ী, মহাখালী ও গাবতলীতে ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীরা বাড়ি যাওয়ার জন্য বাস টার্মিনালে আসছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে, কেউ বা একা আসছেন, টিকেট কাটছেন এবং গন্তব্যে যাচ্ছেন। একটু পরপর যাত্রীদের নিয়ে বাস গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে।



সরেজমিন দেখা যায়, বেশিরভাগ বাস কাউন্টারেই যাত্রী থাকলেও তেমন চাপ নেই। তবে বেশিরভাগ গাড়ির অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তাই টার্মিনালের কাউন্টারে বসে সময় কাটাচ্ছেন টিকিট বিক্রেতারা। তারা বলছেন, দিন দিন বাড়তে শুরু করছে যাত্রীদের চাপ। শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ ছুটি হওয়ায় তারা বাড়ি ফিরতে বাস টার্মিনালে আসছেন। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের এগিয়ে দিতে এসেছেন।


স্ত্রী-সন্তানকে বাসে তুলে দিতে এসেছেন সরকারি চাকরীজীবী আরিফুল হাওলাদার। তিনি বিবার্তাকে বলেন, এখনো ঈদের সরকারি ছুটি শুরু হয়নি। ছুটি হলে মানুষের ভিড় আরও বাড়বে। তাই পরিবারের সবাইকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। না হয় পরে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এখন তেমন ভিড় নেই, টিকিটেরও তেমন চাপ নেই। আসার সাথে টিকিট পেয়ে গেলাম। স্বস্তিতে বাড়ি ফেরার সঠিক সময় এখন। আমি দু'দিন পর বাড়ি যাব।


পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের মহাসড়কগুলো এখন ফাঁকা, নেই ভোগান্তি। তেমন কোনো যানজট নেই, পথ অনেকটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের পথ এখন আরও সহজ হয়ে গেছে।



কাউন্টারগুলোর টিকিট বিক্রেতারা জানান, টিকিট বিক্রিতে এখন তেমন চাপ নেই, তবে যাত্রী আসছে। অফিস-আদালত ছুটি হলে যাত্রীদের চাপ আরও বাড়বে। তবে অগ্রীম টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখন যারা আসছেন তাদের টিকিটের সমস্যা নেই। এসে টিকিট কেটে সাথে সাথে যেতে পারছেন।


ইমাদ পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মহসিন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, সকাল থেকে অনেক যাত্রী এসেছেন এবং টিকিট কেটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। ঈদের এখনো কয়েক দিন আছে। তাই তুলনামূলক যাত্রী কম। আশা করছি সামনে যাত্রী আরও বাড়বে। মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।


এনা টান্সপোর্টের সুপারভাইজার শফিকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, ঈদে মানুষ বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও নানান পেশার মানুষ প্রতিদিন বাড়ি যাচ্ছেন। অনেকে আবার পরিবারসহ বাড়ি যাচ্ছেন। রাস্তায় তেমন যানজট নেই।


খুলনা যাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন-ডাইনিংয়ের একঘেয়ে খাবার খেতে ভালো লাগে না। এখন শুধু অপেক্ষা করছি কখন মায়ের হাতে রান্না করা খাবার খাবো।


তিনি বলেন, আগে পদ্মা সেতু যখন ছিল না, তখন বাড়ি যেতে সময় প্রয়োজন হতো ও ভোগান্তিতে পড়তে হতো। এখন আর কোনো ভোগান্তি নেই। দ্রুত সময়ে বাড়ি চলে যেতে পারি। এখন বাস টার্মিনালে তেমন ভিড় নেই। এসেই টিকিট হাতে পেয়েছি, একটু পর গাড়ি ছাড়বে।


কলেজ শিক্ষক আবু হুরায়রা বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে জীবিকার তাগিদে। এখনো অনেক মানুষের ঈদের ছুটি হয়নি, তাই এখন ভিড় একটু কম। টিকিটের দাম স্বাভাবিক আছে। আগামীকাল থেকে আর গাড়ির টিকিট পাওয়া যাবে না। আর পাওয়া গেলেও ভাড়া হয়ে যাবে ডাবল। এতে মানুষের কিছুই করা থাকবে না।


যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ঈদে ঢাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার বাস চলাচল করবে। গড়ে প্রতিটি বাস দিনে দুই ট্রিপ দেবে। প্রতি বাস গড়ে ৪০ জন যাত্রী পরিবহন করবে। সে হিসাবে দিনে গড়ে আট লাখ, পাঁচ দিনে ৪০ লাখ মানুষ বাসে ঢাকা ছাড়বে। এসব যাত্রীর প্রায় ১০ লাখ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক। অনেক কারখানার শ্রমিক নিজেরাই বাস ভাড়া করবে। তাছাড়া বিকল্প ব্যবস্থায় অনেকে রাজধানী ছাড়বেন। ঈদের বাকি এই ক’দিনে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়বে।


এদিকে ভোগান্তির আশঙ্কা ছাপিয়ে ট্রেনেও স্বস্তির ঈদযাত্রা চলছে। সকাল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে বেশিরভাগ ট্রেন যথাসময়ে ছেড়ে গেছে। স্বাচ্ছ্যন্দে বাড়ি ফিরছেন ট্রেনযাত্রীরা।


আগে ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি ও অভিযোগের চিত্র লক্ষ্য করাও গেলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে প্লাটফর্মে প্রবেশ করছেন টিকিটধারী যাত্রীরা। যাদের টিকিট নেই, তাদের প্লাটফর্মে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।


ঈদযাত্রায় টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ট্রেনের ছাদে চড়েও ভ্রমণে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ঈদযাত্রায় টিকিট ব্যবস্থা অনলাইনে করায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার ভোগান্তি নেই। তবে যারা অনলাইনে টিকিট কাটতে পারেননি, তাদের জন্য স্টেশনে স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটার ব্যবস্থা করা আছে।


ট্রেনের টিকিট না পেয়ে রফিকুল আলম বিবার্তাকে বলেন, সরকার কালোবাজারি ঠেকাতে অনলাইনে রেলের টিকিট বিক্রি করছে। কিন্তু কয়েকদিন চেষ্টা করলেও আমি টিকিট কিনতে পারিনি। ভেবেছিলাম এখানে এসে হয়তো কিনতে পাবো। এখন টিকিট না পেয়ে বাস টার্মিনালে যাচ্ছি। কিছু তো করার নেই, কি করব।


রাজশাহী যাচ্ছেন শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আগের মতো ট্রেনের টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। অনলাইনে টিকিট কিনেছি। তেমন কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। অনেকদিন পর বাড়ি যাচ্ছি মা-বাবা পরিবারের সবার সাথে ঈদ পালন করব।


সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও তেমন ভিড় ছিল না। সাধারণ যাত্রীরা আসছেন, স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষ বাড়ির পথে রওনা হচ্ছেন।


পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সদরঘাটে যাত্রী পাওয়া দুষ্কর ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা এখন যেন পাল্টে গেছে। ঘরমুখী মানুষের ঢল নামতে শুরু করেছে ঘাটে। দক্ষিণাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক ঘরমুখী মানুষ সদরঘাট দিয়ে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে। স্বাভাবিক সময়ে যাত্রী সংকটে প্রতিটি নৌরুটে নিয়মিত ২ থেকে তিনটি করে লঞ্চ স্বল্প যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ানো হয়েছে লঞ্চও। তবে আগের মতো লড়াই করে লঞ্চে উঠতে হচ্ছে না। স্বস্তিতেই যাত্রীরা তাদের গন্তব্যের পথে রওনা হচ্ছেন।


বরিশাল এমভি লঞ্চের টিকিট মাস্টার মো. কামরান হাসান বিবার্তাকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হবার পর লঞ্চে মানুষের চাপ কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এখনো ঈদের কয়েক দিন বাকি আছে। যাত্রীর চাপ আগের থেকে একটু কম। তবে আশানুরুপ না, আশা করছি ঈদের আগে যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে।


তিনি বলেন, তেমন ভিড় না থাকায় সবাই স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারছেন।



যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চে আগের মতো তেমন কোন ভিড় নেই, ভোগান্তিও নেই। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ঈদের কয়েক দিন আগেও টিকিট পাওয়া যেত না। মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ ভিড় কমে গেছে।


বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর থেকে লঞ্চে চাপ কমে গেছে। আগের থেকে আরামে যাওয়া যাচ্ছে। পদ্মা সেতু হওয়ায় অনেক মানুষ বাসে করে বরিশালে যাচ্ছেন, এ জন্য লঞ্চ ঘাটে ভিড় কম।


তিনি বলেন, ঘাটে আসার সাথে সাথেই টিকিট নিতে পেরেছি। ভাড়াও কিছুটা কম রেখেছে। তাই ভোগান্তি কম। মোটামুটি ভালো লাগছে। এখন বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায় আছি।


গৃহিণী নাজমা শাহনাজ ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে লঞ্চের সামনে বসে আছেন বরিশাল যাবেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ঈদের আরও কয়েকদিন বাকি আছে। বাড়ি যাচ্ছি পরিবারের সবার সাথে ঈদ উদযাপন করতে। কষ্ট ও ভোগান্তির কথা চিন্তা করে একটু আগেই যাচ্ছি।


তিনি বলেন, এখন লঞ্চে তেমন কোন ভোগান্তি নেই। বাসে যেতে চেয়েছিলাম, ছেলে-মেয়েদের সমস্যা হয়। তাই লঞ্চে যাচ্ছি বসে শুয়ে যেতে পারব। ছেলে-মেয়েদেরও কষ্ট হবে না।


সেখানেই তপ্ত রোদে ছোট শিশু ফারজানা মুন্নীকে তার মা ও খালা পানি খাওয়াচ্ছেন। শিশু মুন্নী বিবার্তাকে বলেন, গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, দাদা-দাদির সাথে ঈদ করব অনেক মজা হবে।


ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের যাতায়াত স্বাচ্ছন্দ্য করতে সড়ক, মহাসড়ক, রেল ও নৌপথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্য বাড়ানো হয়েছে। কোনও ধরণের যাত্রী হয়রানি, ছিনতাই, মলমপার্টি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং জাল টাকার বিস্তাররোধে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।


তা ছাড়া যেকোনো সমস্যায় পড়লে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশি সহায়তা নিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।


আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গতবারের চেয়ে এবার ঈদ যাত্রা চ্যালেঞ্জিং হবে এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। গতবার ছিল মহাসড়কে শুধু যাত্রী সাধারণকে গন্তব্যে পার করা। এবার একদিকে যাত্রীরা গন্তব্যে যাবেন অন্যদিকে পশুবাহী ট্রাক, পশুবাহী নৌকা যাতায়াত করবে রাস্তাঘাট ও নদীতে। এর সাথে ফলবাহী যানবাহন আসবে, এগুলোকে আটকানো যাবে না। সব কিছু বিবেচনায় রেখে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, সরকার এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রকৌশলী ও রাস্তাঘাটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার সাথে বৈঠক হয়েছে, জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসকগণ বৈঠক করেছেন। আমরা একযোগে কাজ করছি।


পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, নির্ধারিত সময়ে সাধারণ মানুষ যেন গন্তব্যে যেতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে একসাথে কাজ করছে।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com