৪১তম বিসিএস-এর মৌখিক পরীক্ষা চলছে। এদিকে, ৪৩তম ও ৪৪তম বিসিএস-এর লিখিত পরীক্ষার ফলও এখনো প্রকাশিত হয়নি। অন্যদিকে, ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গত ১৯ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-এ নিয়োগে ৪টি বিসিএস কার্যক্রম একসাথে চলছে।
বিসিএসে অংশগ্রহণকারী চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেকগুলো বিসিএসের জট লেগে গেছে। একটা বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বছরের পর বছর লাগছে। ফলে হতাশায় দিনাতিপাত করছেন বিসিএসে অংশগ্রহণকারী চাকরিপ্রার্থীরা। তবে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বলছে, বিসিএসের জট ভাঙতে রোডম্যাপের মাধ্যমে বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। আর সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিসিএসের পরীক্ষায় গতি আনয়ন করা হবে।
তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। এরপর এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২০২১ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে উত্তীর্ণ হয়েছে ২১ হাজার ৫৬ জন। তারপর উত্তীর্ণ এই চাকরিপ্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা ওই বছরের ২৯ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। যার লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রায় ১ বছর পরে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়। যে ফলাফলে মোট ১৩ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর গতবছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা, যা এখন অবধি চলমান রয়েছে অর্থাৎ এই বিসিএসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে এই পর্যন্ত তিন বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা এখনো সম্ভব হয়নি।
এদিকে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম সাধারণ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেয় পিএসসি। এরপর ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর ২০২২ সালের বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) বিকেলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ওয়েবসাইটে এই বিসিএসের প্রিলির ফল প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত ফলাফলে ১৫ হাজার ২২৯ জন প্রার্থী প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর গত বছরের ২৪ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল এখন অবধি প্রকাশ করা হয়নি। এই বিসিএস নিয়ে পিএসসি বলছে, প্রথম ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের দেয়া নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশের বেশি হওয়ায় খাতাগুলো এখন তৃতীয় পরীক্ষকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর। এরপর ২০২২ সালের ২৭ মে এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার ২৫ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে রেকর্ড করে পিএসসি। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ১৫ হাজার ৭০৮ জন প্রার্থী পাস করেন। তারপর ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়ে চলে ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত।
এদিকে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরপর গত ১৯ মে এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলাফল ১৫ দিনের মধ্যে প্রকাশ করার কথা জানিয়েছে পিএসসি।
টানা ৪টি বিসিএস জট লেগে যাওয়ার বিষয়ে বিসিএসে অংশগ্রহণকারী চাকরিপ্রার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন ৪টি বিসিএসের জট লাগিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা চাই পিএসসি একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করে সেটি মোতাবেক কাজ করে দ্রুত বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হোক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ৪০ তম বিসিএসে ভাইভা দিয়ে নন ক্যাডার হয়েছেন মো. আমিনুল ইসলাম আশিক। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ২০২২ সালের ৩০ মার্চ ৪০ তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। যেখানে আমি নন ক্যাডারে পাস করেছি। অথচ এই ফলাফলের পর ১ বছর পেরিয়ে গেলেও নন ক্যাডারে কাউকে সুপারিশ করা হয়নি। ফলে আমার মতো নন ক্যাডারে চাকরি প্রত্যাশীরা হতাশায় দিনাতিপাত করছেন।
তিনি বলেন, ৪১তম বিসিএসেও আমি ভাইভা দিয়েছি। কিন্তু তার চূড়ান্ত ফল কবে হবে, তা জানি না। এদিকে ৪৩ তম বিসিএসেও আমি লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু সেটারও লিখিত পরীক্ষার ফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। ফলে আমি বিসিএস ট্যাগে থেকেও হতাশায় পড়েছি। কারণ, অন্য চাকরির পেছনে আমি দৌড়াইনি। একমাত্র বিসিএসই দিতাম। কিন্তু বিসিএসেও যে জট লেগেছে তাতে নিজেকে অসহায় লাগছে।
শফিকুল ইসলাম শফিক নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আরেক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, একটা বিসিএসের পেছনে ৩ বছরের অধিক সময় লেগে যায়। এরপর যদি কেউ বিসিএস ভাইভা দিয়ে নন ক্যাডার থেকেও কিছু না পায়, তাহলে সে কতটা হতাশ হবে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারবে। আমি মনে করি, একটা বিসিএসকে এক বছরের মধ্যে চূড়ান্ত করে নিয়োগ দেওয়া উচিত। তাতে করে যার চাকরি হবে সেই করবে, আর যার হবে না, সে অন্যদিকে ঝুঁকবে। জট লাগিয়ে কয়েকটা বিসিএস একসাথে থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
তিনি বলেন, বিসিএস পরীক্ষা এমনিতেই কয়েকটা ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। এক একটা ধাপে তুমুল প্রতিযোগিতা করে চাকরিপ্রার্থীদের উত্তীর্ণ হতে হয়। কাজেই সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক এই চাকরি পরীক্ষায় জট লেগে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের জন্য চরম হতাশার। আমি পিএসসিকে এই কাজে গতি বৃদ্ধি করার জোর দাবি জানাই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাস করে ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেছেন কামরুল ইসলাম রবিন। তিনি এই বিসিএসে প্রিলি, রিটেন উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায়ও অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর থেকে ৩ বছরের অধিক সময় হয়ে গেলেও ৪১তম বিসিএসের এখন অবধি ভাইভা পরীক্ষা চলমান রয়েছে। এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল দিতে আরো কতদিন সময় লাগবে তা বলতে পারবো না। এভাবে চলছে আর কী! অথচ একটা বিসিএসের চূড়ান্ত ফল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়া সম্ভব হলে তাহলে যারা কাঙিক্ষত ক্যাডার পেয়ে যেতেন, তারা আর আবেদন করতেন না। এখন তো ৩/৪ বিসিএস জট লেগে গেছে। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়ে সবগুলোতে অংশগ্রহণ করা লাগছে।
তিনি বলেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া ও নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া এমনিতে দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষার ও সাধনার ফসল। অনেকের কাছে এটা স্বপ্নের নাম। কাজেই জটে পড়ে এই পরীক্ষার ফলাফল বিলম্বিত হওয়া চাকরিপ্রার্থীদের জন্য খুবই হতাশার। অবিলম্বে বিসিএসের দ্রুত ফলাফল প্রদানে পিএসসির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
বিসিএসের বিলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা জানিয়ে "চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির" আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ বিবার্তাকে বলেন, চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের কাছে বিসিএস খুবই আকর্ষণীয় জব। কিন্তু সেখানেও হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। একটা বিসিএসের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে যদি ৩/৪ বছর লেগে যায় সেটা কি মেনে নেওয়ার মতো? এমনিতে এখন চাকরির বাজার খুবই মন্দা। এদিকে বিসিএসও যদি এভাবে বিলম্বিত প্রসেসে আগাতে থাকে, তাহলে চাকরিপ্রার্থীরা কোথায় যাবে? তাদের তো বয়সসীমাও বসে থাকবে না।
তিনি বলেন, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা করে বিসিএসের আবেদন ফি নেয়া হয়। কিন্তু এরপরেও কেন এখানে বিলম্ব? টাকা নেই, সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিতে হবে, বিষয়টি তো এমন নয়। কাজেই কী কারণে দেরী হচ্ছে, কারা এর জন্য দায়ী? এই বিষয়গুলো এখনই তদন্ত করা উচিত।
বিসিএসের জট লেগে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বিবার্তাকে বলেন, করোনা মহামারি এবং আগের বিসিএস পরীক্ষার অসম্পূর্ণ কাজের কারণে আমরা আমাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা এখন নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমানোর জন্য কাজ করছি।'
তিনি বলেন, বিসিএসের গতি বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে বিসিএসের যে জট সেটি কেটে যাবে। আমরা আশা করছি ২০২৪ সাল থেকে বছরে একটি বিসিএস শেষ করতে পারব।
বিবার্তা/রাসেল/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]