
আর ক'দিন পরই ঈদ। বছরের এই সময়ে হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখর থাকত রাজধানীর যে দুই মার্কেট- আজ সেখানে শুধু আগুনে পোড়া কাপড়ের গন্ধ আর ধ্বংসস্তূপ। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের অনেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন আবার কেউ নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে মরিয়া। এছাড়া কর্মীদের বেতন-বোনাস, দোকান ভাড়া কিংবা ঋণের কিস্তিইবা কিভাবে শোধ করবেন সে হিসেবও কষছেন অনেকে।
গত ৪ এপ্রিল ভোর ৬টার দিকে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় রাজধানীর বঙ্গবাজারের হাজারো দোকানপাট। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন টিন, কাঠ ও লোহার কাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়। উত্তর দিকের মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, সাততলা বিশিষ্ট এনেক্সকো টাওয়ারের অধিকাংশ দোকানই ভষ্মীভূত হয় আর বাকিগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এদিকে গত ১৫ এপ্রিল ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউ মার্কেট সংলগ্ন তিন তলা ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে (দক্ষিণ ভবন) আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং বিজিবি সদস্যদের চেষ্টায় এই বিপণি বিতানে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এর আগেই আগুনে পুড়ে ছাই হয় শত শত দোকানের মালামাল। আর আগুনের সাথে মিলিয়ে গেছে ব্যবসায়ীদের সকল স্বপ্ন সাধ।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) মার্কেট দু'টি ঘুরে দেখা গেছে, বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে গত ১২ এপ্রিল পাঁচ ফুটের অস্থায়ী চৌকিকে সঙ্গী করে আবারো ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করছেন। আর ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এখনো বসার সুযোগই পাননি। সিটি করপোরেশন ও মার্কেটের কর্মীরা এখনো মার্কেট পরিষ্কারের কাজ করছেন।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২৪ বছর ধরে ব্যবসা করেন আনোয়ার হোসেন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স গুলিস্থান ইউনিটের নিচতলায় রাজু গার্মেন্টস নামে দু'টি দোকান আর তিন তলায় একটি গোডাউন ছিল তার। দোকানে কর্মচারী ছিল তিন জন। গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে তার দোকান ও গোডাউন পুড়ে গেছে। দুই দোকান এবং গোডাউন মিলে অন্তত ৮০ লাখ টাকার কাপড় ছিল। তার সবই পুড়ে ছাই হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, সামনে ঈদ তাই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে হাওলাদ করে অন্তত ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকার কাপড় তুলেছিলাম। অথচ আগুন লাগার পর দুই চাবি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই।
গত ১২ এপ্রিল অস্থায়ী চৌকি পেতে বঙ্গবাজারে বেচাকেনা শুরু করেছেন আগুনে সব হারানো ব্যবসায়ীরা। সেখানেই কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সাথে। কড়া রোদে মাটিতে ছাতা পুতে দোকানে বসেছিলেন তিনি। বিক্রি কেমন হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর ঈদুল ফিতরের সাতদিন আগেও দিনে লাখের ওপর সেল হয়েছে। ৬দিন ধরে চৌকি নিয়ে বসেছি। একদিন ২৭০০ টাকার, আরেক দিন ১১০০ টাকার বিক্রি করেছি। এরকম যাচ্ছে। ৫ হাজার টাকার গেঞ্জি আইটেম নিয়ে বসেছি। কত হাজারই আর বিক্রি করব। ইনভেস্টই তো ৫ হাজার।
দোকান কর্মচারীদের বেতন, ঈদ বোনাসের ব্যাপারে জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, আগে আমার সাথে তিন জন ছিল। দুইজনই বাসায়। আমি ওদেরকে কই থেকে দিব, এখন আমি নিজেই তো খাইতে পারি না। আমি নিজেই চলতে পারতেছি না। কই থেকে দিমু, একজনরে রাখছি তাও কষ্ট অইয়া জায়গা। বেতন দেয়ার মতো আমার কাছে কোন কিছুই নাই।
বঙ্গবাজার ইউনিটের পাটোয়ারী ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম পাটোয়ারী। তিনি বিবার্তাকে বলেন, বড় আপার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসায় বসেছি। ১৩ এপ্রিল থেকে এভাবে (চৌকি নিয়ে) আছি। বেচাকিনি নাই। আজকে তো (মঙ্গলবার বিকাল ৪টা) বিসমিল্লাও হয়নি। প্রথমদিন ৬০০, পরের দিন ৯০০, কালকে বেচছি ১৯০০ টাকা। সাতদিনে ১০ হাজার টাকাও হবে না। খরচের টাকা হয় না, অবস্থা খুবই খারাপ।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের শুরু থেকেই এই মার্কেটে ব্যবসা করছেন আবুল কালাম। ১৯৯৫ সালের আগুনেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ বঙ্গবাজার ইউনিটে ৩৫ বর্গফুটের দোকান ছিল তার। দোকান থেকে এক টাকার মালামালও বের করতে পারেননি কালাম।
কর্মচারীদের বেতন, ঈদের বোনাসের ব্যাপারে কি চিন্তা করছেন? জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, গত বছর তো বেতন বোনাস দিছি। এবার তো দিতে পারমু না। এবার দেয়া সম্ভবই না। আমারি তো টাকা নাই। যাও ভাবছিলাম বেচাকিনি হইলে ২-৪ হাজার পারলে দিমু। কিন্তু সম্ভাবনা কম। কি আর করা- বলেন তিনি।
বঙ্গবাজার ইউনিটের জান্নাতুল গার্মেন্টস স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ করিম। তিনদিন হলো তিনিও চৌকি নিয়ে ব্যবসায় বসেছেন। মাসুদ করিম বিবার্তাকে বলেন, ছোট ভাইয়ের বন্ধু, কাকাত ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু কাপড় নিয়ে বসেছি। প্রথম দিন দুই-তিনশ টাকা, পরদিন আড়াই হাজার আর আজকে ১০০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। সংসার আছে, চলতে তো হইব।
ব্লাক ম্যানসওয়ারে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন মো. ফয়সাল। বঙ্গবাজার ইউনিটে অস্থায়ী চৌকিতে কাপড় নিয়ে বসেছিলেন তিনি। ফয়সাল বিবার্তাকে বলেন, আগে তো দোকান ছিল, এখন তো দোকান নাই বেচাবিক্রিও ভালো না। যা ছিল সবকিছু শেষ। গরমে বসাও যাচ্ছে না। এই গরমে কি বসা যায়?
তিনি বলেন, গত বছর ঈদের আগে দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) বিকাল ৩টা পর্যন্ত মাত্র ১৫০০ টাকা বেচছি ভাই।
বেতন-বোনাসের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফয়সাল বলেন, আমরা দুইজন আছি। গতবার তো দিসে, এবার তো কইতে পারি না। মাহাজনরে কইয়া লাভ হইব না। চাপ দিয়াও লাভ হইব না। খুশি মনে যা দেয় তা মাথা পাইতা নিতে হইব। পরিস্থিতি তো দেখতাছি।
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় স্টাইল আইকন নামে দোকান ছিল মো. বাহার পাঠানের। তিনি বিবার্তাকে বলেন, দোকানে ৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। ঈদের আগে দিনে ১ লাখ টাকার মতো বেচাবিক্রি হত। আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসা একেবারে বন্ধ। দোকান কোথায় দিবেন এখনো তা জানেন না। মার্কেট সমিতির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
এই মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস বিবার্তাকে বলেন, আগুনে আমার অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। ঈদ সামনে, লোন নিয়ে মাল তুলছিলাম। সবই তো শেষ। লোনের কিস্তি দিতে হবে, এখন কি করব জানি না।
কর্মীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার দোকানে দু'জন কাজ করত। সবই তো শেষ। বেতন-বোনাস কিভাবে দিব?
স্পাইডারম্যান-২ নামে একটি দোকানের ম্যানেজার ছিলেন মো. ফায়সাল। ২০০৯ সাল থেকে এই মার্কেটে কাজ করেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমাদের দোকানে ১০ লাখ টাকার মাল ছিল। সব পুড়ে গেছে। আমরা কিছুই বের করতে পারিনি। গত বছর ঈদেও দিনে অন্তত ৫০-৬০ হাজার টাকা সেল হইছে। এবার তো ব্যবসাই নাই, সব শেষ।
তিনি বলেন, দোকানে আমিসহ তিনজন কাজ করি। এখন উনাদের (মালিক) যদি ইচ্ছা হয় তাহলে কিছু পাব। এরা বাঁচলে না আমরা বাঁচমু।
ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পূর্ব অংশের দোকানগুলো একেবারে পুড়ে গেছে। দ্বিতীয় তলার পশ্চিমাংশে বেশ কিছু দোকান চালু রয়েছে। আর যেসব দোকানে অল্প ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তারাও মালামাল গোছানোর কাজ করছেন। নাহার কালেকশনের সানজু ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। আপাতত ধোয়া-মোছার কাজটি করছি। ঈদের ৪-৫ দিন বাকি আছে। যদি কিছু বেচাবিক্রি করতে পারি।
বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]