চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলে নানা অসঙ্গতি, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা!
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৫
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলে নানা অসঙ্গতি, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিবন্ধন পরীক্ষায় জাতীয় মেরিট লিস্টে ব্যাচ আলাদা হলেও রোল একই হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে- আমি ১২ তম ব্যাচের, এদিকে ১৪ তম ব্যাচের একজন রয়েছে তার রোলও আমার সেইম রোল। আমি খোঁজ করে জেনেছি, আমার সেইম রোলধারী একজন নারী। তিনি দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ডিগ্রি  কলেজে চান্স পেয়েছেন। পরে তিনি এই কলেজে জয়েন করেছেন। তার ইনডেক্স নাম্বারও আছে। সেটা আমি বের করেছি। যেহেতু তিনি ইনডেক্সধারী, সেহেতু এবার এনটিআরসিএ এর নিয়ম অনুযায়ী ইনডেক্সধারী এবং ৩৫ ঊর্ধ্বদের আবেদনের সুযোগ নেই। আর এই নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে এনটিআরসিএ ইনডেক্সধারীদের রোলগুলো সংগ্রহ করে টেলিটককে দিয়ে ব্লক করতে বলেছেন, যাতে তারা আবেদন না করতে পারেন। এখন আমার সেইম রোলধারীর ইনডেক্স থাকায় উনার রোল ব্লক করার কারণে দুর্ভাগ্যক্রমে আমার রোলটাও ব্লক হয়ে গেছে। এজন্য আমি মেরিট লিস্টে এগিয়ে থাকার পরেও সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি।


১২তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মো: মামুন অর রশিদ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফলের অসঙ্গতি তুলে ধরে বিবার্তাকে এসব কথা বলেন।


তিনি বলেন, আমি ১২তম নিবন্ধনে কলেজ পর্যায়ে রসায়ন বিষয়ের প্রভাষক পদে নিবন্ধিত। আমার মেরিট পজিশনও ভালো ছিল। আমার পরে ১৩ জনকে সিলেক্ট করা হয়েছে কিন্তু রোল ব্লক থাকায় আমাকে সিলেক্ট করা হয়নি।


উপরিউক্ত অভিযোগ শুধু মামুন অর রশিদের নয়। একই অভিযোগ করেছেন আরো অসংখ্য চাকরিপ্রত্যাশী।


১২ মার্চ, রবিবার রাতে শিক্ষক নিয়োগে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশের পর থেকে ফলাফলের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে অভিযোগ করতে থাকেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব রয়েছেন তারা।



কারো মেরিট পজিশন ভালো অবস্থানে থেকেও বাদ পড়া, এদিকে মেরিটে পিছিয়ে থাকা অনেকের সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া, আবার কারো রোল ইনডেক্সধারীদের রোলের সাথে মিল থাকায় ব্লক হয়ে বাদ পড়া, আবার কেউ কেউ ৩৫ বছর ঊর্ধ্ব হয়ে গেলেও সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়াসহ নানা অভিযোগ চাকরি প্রত্যাশীদের।


মোহাইমিনুল ইসলাম নামের এক চাকরিপ্রত্যাশী বিবার্তাকে বলেন, আমরা চরম হতাশাগ্রস্থ হই যখন দেখি আমাদের চয়েজ লিস্টে আমাদের চেয়ে কম মেধাবীদের (বেশি মেরিট ও সিরিয়াল) সুপারিশ করা হয়েছে। এটা দেখে মানসিকভাবে ঠিক কতোটা ভেঙ্গে পরেছি, তা ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না। সারা জীবনের আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন মুহূর্তেই চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে গেছে।


ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, নিবন্ধনের প্রথম ব্যাচ থেকেও চাকরি হওয়ার খবর আসছে। অথচ প্রথম ব্যাচের নিবন্ধন পরীক্ষা ২০০৫ সালে হয়েছিল। দ্বিতীয় নিবন্ধন ২০০৬ সালে হয়েছে। কিন্তু এবারের গণবিজ্ঞপ্তিতে সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর ছিল। সেই হিসেবে প্রথম ব্যাচ থেকে  সুপারিশ পেতে হলে কাউকে ১৭ বছর বয়সে স্নাতক, দ্বিতীয় ব্যাচ থেকে চাকরির সুপারিশ পেতে হলে ১৮ বছর বয়সে তাকে স্নাতক শেষ করতে হবে। যা দেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব। অথচ প্রথম ব্যাচের প্রার্থীও সুপারিশকৃত হয়েছেন। ভাবা যায়?


১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনে আইসিটি (প্রভাষক) বিষয়ে জাতীয় মেধাক্রমে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছেন মো. আল মেহেদী। তিনি বলেন, আমার চয়েজ অর্ডারের ১ম এবং ২য় কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সের ১৮৯ ও ৭০ মেধাক্রমকে সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ আমি মেধাক্রমে পঞ্চম অবস্থানে থেকেও সুপারিশ পাইনি। আমি এই রেজাল্ট মানি না। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশ বাতিল করে নতুন করে সুপারিশ করতে হবে।


এদিকে ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে রোল ব্লক জনিত সমস্যার কারণে সুপারিশ বঞ্চিত প্রার্থীদের মেধাক্রমের ভিত্তিতে দ্রুত সুপারিশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ২৩ জন প্রার্থী গত ১৯ মার্চ বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।


"৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ভুক্তভোগী ও মেধাক্রমের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রত্যাশী শিক্ষক ফোরাম" সংগঠনের পক্ষ হইতে দেওয়া এই স্মারকলিপি বলা হয়, বেকারবান্ধব গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের লক্ষ্যে গত ২১/১২/২০২২ ইং তারিখে ৬৮৩৯০টি শূন্যপদের বিপরীতে বহুল কাঙ্ক্ষিত ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৯/০১/২০২৩ ইং তারিখে আবেদন শেষ হয় এবং ১২/০৩/২০২৩ ইং তারিখে প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়। প্রার্থীদের মেধাক্রম, পছন্দক্রম ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ৩২৪৩৮ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয় বলে এনটিআরসিএ'র ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। যেটা এনটিআরসিএ'র বেকারের অভিশপ্ত থেকে সনদধারীদের মুক্তির পথের অন্যতম সাফল্য।


চাকরিপ্রার্থীরা বলেন, এনটিআরসিএ'র অটোমেটিক সফটওয়্যার সিস্টেমের মাধ্যমে এতোটা স্বচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতির পরেও নিজেদের মেরিট লিস্টে এগিয়ে থেকেও নির্বাচিত না হতে দেখে আমরা ভেবে নেই, হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে কিংবা আমাদের রোল অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কারণে ব্লক করা হয়েছে। তখন আমরা জাতীয় মেরিট লিস্ট সার্চ করতে গিয়ে দেখতে পাই, ব্যাচ ও নাম আলাদা হলেও জাতীয় মেরিট লিস্টে আমাদের রোলের মতো একাধিক রোল রয়েছে। সেই রোলের কোনো একজন ব্যক্তি ম্যানেজিং কমিটি বা এনটিআরসিএ'র কোনো একটি গণবিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচিত হয়ে যোগদান করেছে এবং ইনডেক্স প্রাপ্ত হয়েছে অথবা কারও ক্ষেত্রে বয়স এনটিআরসিএ নির্ধারিত বয়সসীমা (৩৫ বছর) অতিক্রম করেছে। সঙ্গত কারণেই এনটিআরসিএ থেকে সেই রোল ব্লক করায়, দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের রোলটিও ব্লক হয়েছে। তাই আমাদের নির্বাচিত না করে আমাদের চেয়ে মেরিট ও সিরিয়ালে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।


সুপারিশ বঞ্চিত এই চাকরিপ্রার্থীরা বলেন,আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চয়েজ লিস্টের প্রতিষ্ঠানে পুলিশ ভেরিফিকেশনের আগে প্রাথমিক সুপারিশ করিয়া বেকার জীবনের চরম হতাশার গ্লানি, চিন্তা ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে সুস্থ, স্বাভাবিক ও আদর্শ শিক্ষক হিসেবে দেশের সেবায় যেন নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারি সেই সুযোগ প্রদানের পূর্ণ, যোগ্য অভিভাবক হিসেবে এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে প্রাথমিক সুপারিশ করার জন্য সবিনয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি।


দাবি জানিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা বলেন,আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের এই সমস্যার সমাধান করে আমাদের চয়েজকৃত প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত করে প্রাথমিক সুপারিশ প্রার্থীদের সাথে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হোক।


এরআগেও ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফলে অসঙ্গতির অভিযোগ এনে গত ১৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে "৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ভুক্তভোগী ও মেধাক্রমের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রত্যাশী শিক্ষক ফোরাম"।



চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফলে নানা অসঙ্গতির সমাধানের জন্য প্রতিদিনই এনটিআরসিএতে স্বতন্ত্রভাবে অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও দুইবার সমন্বিত স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছ। কিন্তু এরপরেও ফলাফল প্রকাশের ৯ দিন পার হলেও, এনটিআরসিএ থেকে আমাদের সমাধানের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায় নি।



দাবির বিষয়ে তারা বলেন,আমাদের দাবি হচ্ছে ২ টি। তা হলো-


১. প্রকাশিত প্রাথমিক ফলাফল বাতিল করে এবং ব্লক সমস্যার সমাধান করে নতুনভাবে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। অথবা


২. প্রাথমিক ফলাফলে নির্বাচিত প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশনের আগে আমাদের সমস্যার সমাধান করে আমাদেরকেও সুপারিশ করতে হবে এবং তাদের সাথে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সুপারিশে নিজ জেলাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সেখানেও আমাদের চয়েজের ব্যবস্থা রাখতে হবে।



এদিকে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে এনটিআরসিএ। গত ১৬ মার্চ ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তির আওতায় বিভিন্ন পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ১ম থেকে ৫ম শিক্ষক নিবন্ধনধারী প্রার্থীদের সনদ ভালোভাবে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ফের সনদ দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আরেক বিজ্ঞপ্তিতে ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তির আওতায় প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), প্রভাষক (কম্পিউটার অপারেশন), প্রদর্শক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), কম্পিউটার (প্রদর্শক) এবং সহকারী শিক্ষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের তথ্যও ফের চাওয়া হয়।


এই ‍দুই বিজ্ঞপ্তিতে হুঁশিয়ারী দিয়ে আরো বলা হয়, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে উভয় সনদের সত্যায়িত ফটোকপি ও ছকে চাহিদাকৃত তথ্য প্রেরণে ব্যর্থ হলে নিয়োগ সুপারিশের জন্য বিবেচনা করা হবে না।


চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলে নানা অসঙ্গতির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এর (এনটিআরসিএ) সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল নিয়ে যাদের অসঙ্গতির অভিযোগ রয়েছে, তাদের অভিযোগপত্র দিতে বলেন। আমরা ভেরিফাই করে দেখবো। কোন সমস্যা থাকলে আমরা অবশ্যই দেখবো।


তিনি বলেন, দুই একটা ভুল হতে পারে। কিন্তু অসঙ্গতি বলতে মানুষ যেটা বোঝাচ্ছে, সেটা আসলেই না। আমরা তো মিলিয়ে দেখছি। আমরা একটা একটা করে যেগুলো আবেদন পাচ্ছি, সেগুলোকে মিলাচ্ছি। কাজেই যাদের অভিযোগ রয়েছে, তারা আবেদন দিলে আমরা ফাইনাল সুপারিশের আগে তথ্য দিয়ে দেবো।


প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান বিবার্তাকে বলেন, চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করেছে টেলিটক। অটোমেটিক পদ্ধতিতে এই কাজ করা হয়েছে।  এক্ষেত্রে হয়তো টেকনিক্যাল কিছু ভুল থাকতে পারে।


তিনি বলেন, যারা জাতীয় মেধাতালিকার পাশাপাশি বিষয় ভিত্তিক মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও নিয়োগের সুপারিশ পাননি; তাদের আবেদনগুলো দেখা হচ্ছে। মোটকথা,  অভিযোগ সঠিক হলে আমরা সেটি সংশোধন করে দেবো।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com