লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পাসপোর্ট করতে নাজেহাল মানুষ!
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ১০:০০
লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পাসপোর্ট করতে নাজেহাল মানুষ!
কিরণ শেখ
প্রিন্ট অ-অ+

পাসপোর্ট করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ফরম নিতে যেমন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তেমনি ঘুরতে হচ্ছে সাত থেকে আটটি কক্ষে। এজন্যও হয়রানির শিকার হচ্ছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। আর দালাল না ধরলে এবং দালালকে টাকা না দিলে পাসপোর্টও নির্ধারিত সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোগান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অফিস থেকে বের হওয়ার সময় পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা কর্মকর্তাদের গালাগাল দিতে দিতে বের হন।


গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দেখে গেছে, পাসপোর্ট ফরম নিতে আটটি লাইন করা হয়েছে। এই আটটি লাইনে প্রায় এক হাজারেরও বেশি পাসপোর্ট প্রত্যাশী ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনেক আবার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হয়রান হয়ে বসে পড়ছেন। কেউ কেউ নিজের জায়গায় বন্ধু কিংবা স্বজনকে দাঁড় করিয়ে নিজে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিশ্রাম শেষে আবার দাঁড়াচ্ছেন।


এসময় পাসপোর্ট প্রত্যাশী মেহেদী হাসান রাব্বির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি এসেছেন রাজধানীর লালবাগ থেকে। মেহেদী হাসান রাব্বি বিবার্তাকে বলেন, প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনো ফরম নিতে পারি নাই। জানি না আর কত সময় লাগবে। ফরম নিতে লাইনে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি মনে হচ্ছে।


এদিকে এমআরপির যুগ পেরিয়ে বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করলেও ভুল থেকেই যাচ্ছে। গ্রাহকের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, নতুন পাসপোর্ট করতেও যত টাকা লাগে, ভুল সংশোধন করতেও ততই লাগে। এক টাকাও কম না। বিশ্বের কোন দেশেই এমন নিয়ম নেই। সবচেয়ে বেশি ভুল হয় আগের পাসপোর্ট ও এনআইডি কার্ডের মধ্যে মিল না থাকায়। নতুন নিয়মে পুরনো পাসপোর্টে মুদ্রিত নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং জন্ম তারিখ পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর এ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে এখানে।


এছাড়া পাসপোর্ট সংশোধনের জন্য আবেদন করেও দ্রুত ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছে না। আবেদন করে সময়মত ‘পাসপোর্ট’ না পাওয়া, পাসপোর্ট রিনিউ করার জন্যও দ্বিতীয়বার আবেদন করতে হচ্ছে। কারণ ঢাকাসহ মেট্রোপলিটন এলাকায় থানা ভাগ হওয়া, বর্ডার মেশিন মাঝে মাঝে অচল হওয়া ও ছবি ঠিকমতো না ওঠার কারণেও গ্রাহকরা ভোগান্তিতে আছেন।



অন্যদিকে পাসপোর্ট অফিসের জনবলের অভাব, পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঢিলেঢালা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণের প্রিন্ট মেশিন না থাকার কারণেও পাসপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। আর এখন শুধুমাত্র ই-পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। কারণ করোনার সময় এমআরপি পাসপোর্ট বন্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে।



গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, লাইনে দাঁড়ান একজন পাসপোর্ট প্রত্যাশীকে এক দালাল বলছেন, আপনাকে আমি যা যা বলেছি- ওখানে গিয়ে তাই তাই বলবেন। না হলে কিন্তু সমস্যা হবে। প্রত্যুত্তরে পাসপোর্ট প্রত্যাশী মাথা নাড়ান।


এসময় কথা হয় পাসপোর্ট প্রত্যাশী মো. সিদ্দিকের সাথে। তিনি গালাগালি করতে করতে পাসপোর্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, আজকে জীবন শেষ হয়ে গেল।


জীবন কেনো শেষ হলো- জানতে চাইলে মো. সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, পাসপোর্ট করতে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। এরপর আবার ৭ থেকে ৮ রুমে দৌড়াতে হয়েছে। জীবন তো শেষ হবেই। এ থেকে সাধারণ মানুষের রক্ষা যে কবে হবে- প্রশ্ন রাখেন তিনি।


পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন রাসেল। তিনি গত ৯ মার্চ, বৃহস্পতিবার আগারগাঁও অফিসে পাসপোর্ট নিতে এসেছিলেন। এসময় রাসেলের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বিবার্তাকে বলেন, পাসপোর্ট করতে তো একটু ভোগান্তি হয়ই। আমি একমাস পরে পাসপোর্ট পাচ্ছি।


৫ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৫,৫০০ টাকা। জরুরি পাসপোর্ট’ ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৭,৫০০ টাকা এবং অতি জরুরি পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ১০,৫০০ টাকা।


১০ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার সাধারণ পাসপোর্ট ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৭,০০০ টাকা। ৬৪ পাতার ‘জরুরি পাসপোর্ট’ ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৯,০০০ টাকা। ৬৪ পাতার অতি জরুরি পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ১২,০০০ টাকা। ফি’র সঙ্গে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট জমা দিতে হয়।


এবিষয়ে এক পাসপোর্ট প্রত্যাশীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা। তবে তিনি পাসপোর্টর জন্য আবেদন করেছেন বলে নামপ্রকাশ করতে চাননি। তিনি বিবার্তাকে বলেন, দালালকে ধরলেই দ্রুত দুই দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি যদি দালাল না ধরেন তাহলে পাসপোর্ট পেতে কোন কোন সময় তিন মাসও সময় লাগে। কারণ নিজে পাসপোর্ট করলে যত টাকা দিতে হয়, দালাল ধরলে তার চেয়ে দ্বিগুণ কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি টাকা দিতে হয়।


জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, পাসপোর্ট করতে ভোগান্তির কোন সুযোগ নেই। কারণ ভোগান্তি এখন শেষ। আর পাসপোর্ট হওয়ার পরে ভুলের কোন সুযোগ নেই। কারণ কম্পিউটার কোন ভুল করে না। ভুল করে মানুষ।


এবিষয়ে জানতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন) সেলিনা বানুর সঙ্গে মোবাইল ফোন যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।


পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয় জানতেে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অর্থ) উম্মে সালমা তানজিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে বিবার্তা থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেনি।


পাসপোর্ট করতে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে ভোগান্তির সুযোগ নেই। আবার, তাদের সাথে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। তাহলে মানুষ কোথায় পাবে সমাধান? না এভাবেই চলবে জনদুর্ভোগ নিয়ে বাংলাদেশ?


বিবার্তা/ কিরণ/ রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com