ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ঢামেক : রোগীদের ভোগান্তির শুরু আছে, শেষ নেই
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ১০:০১
ঢামেক : রোগীদের ভোগান্তির শুরু আছে, শেষ নেই
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ সারি। কোনো অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে আসছে, আবার রোগী অথবা নিস্প্রাণ দেহ নিয়ে গন্তব্যে ফিরছে। আশপাশে চালকদের আনাগোনা। যেখানে অ্যাম্বুলেন্সের সারি, সেখানে লেখা রয়েছে ‘কেবলমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রাখার নির্ধারিত স্থান’। কিন্তু সেখানে সরকারি কোনো অ্যাম্বুলেন্স চোখে পড়ল না, সবই বেসরকারি। হঠাৎ একটি অ্যাম্বুলেন্স বের হতেই চোখে আটকে গেলো একটা নিথর দেহের উপর। কাছে যেতেই দেখা গেল, লোকটি উপুড় হয়ে দু’হাত মাথার সামনে বাড়িয়ে পড়ে আছেন। তার হাত-পাসহ শরীরের বি়ভিন্ন পঁচে যাওয়া অংশে পোকামাকড়ের বসতি। ছবি তুলতে গেলে ৩-৪ জন আনসার সদস্য ঘিরে ধরেন এবং চড়াও হন। বাধা দিয়ে বলেন- এই মিয়া এহানে ছবি তোলা যাইবো না, যান যান যান।


বলছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের কথা। দৃশ্যটি শনিবার দুপুরের। ছবি তোলার পর অল্প সময়ের মধ্যেই সেই পঁচে যাওয়া ব্যক্তিটির স্থান হয় জরুরি বিভাগে। ভেতরে গিয়ে জানা যায়, ব্যক্তিটিকে মৃত ঘোষণা করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। মরদেহ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।




ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু সেই হাসপাতালের ভেতরেই যদি কোনো ব্যক্তি বিনা চিকিৎসায় মরে পড়ে থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবে কোথায়--এমন প্রশ্ন করেন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী। জরুরি বিভাগের পাশেই একজন মানুষ মরে পড়ে আছেন, কেউ দেখল না? এমন প্রশ্নের জবাবে কর্তব্যরত চিকিৎসক বললেন, ‘আমরা কিছু জানি না। আর মরদেহের স্বজনও তো নেই।’



রাজধানীসহ সারা দেশের সংকটাপন্ন রোগীদের আস্থার প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা প্রত্যাশা করেন দেশসেরা এই হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা পাবেন। কিন্তু রোগীর ফি জমা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। দালালদের উৎপাত আর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এসব অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেখার মতো তেমন কাউকে দেখা যায়নি।


ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ভালো সেবার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে এসে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়, দালালের খপ্পরে। এমনকি অনেক পরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে থেকে করে আনতে হয়। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। থাকলেও নানা অজুহাতে করতে চায় না। আইসিইউতে নেই পর্যাপ্ত সিটের ব্যবস্থা।



বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বহু সরঞ্জাম প্রায় বিকল হয়ে পড়েছে। এগুলো সারিয়ে কার্যকর করার ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। এছাড়া অন্তত ২০ শতাংশ রোগের পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই হাসপাতালে। এই সুযোগে হাসপাতালের ভেতরে গড়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক-কর্মীদের শক্তিশালী চক্র। হাসপাতালের কিছু কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীর যোগসাজশে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট, যারা নানা অজুহাতে রোগীদের কাছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।



হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী মো. শাহজামাল বিবার্তাকে বলেন, প্রেসক্রিপশন নিয়ে চিকিৎসকের রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর আমাকে কয়েকজন পরীক্ষাগুলো বাইরে করানোর পরামর্শ দেয়। বলে সরকারিতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আমি বলি দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত হাসপাতালে আসা-যাওয়া করছি, প্রতিনিয়ত আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হয়, যে কারণে বাইরে গিয়ে বেশি টাকা খরচ করে পরীক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর আসে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ কিছু দালাল। তারা এখানকার স্টাফ বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনারে এহেনের (ঢাকা মেডিকেল) ফিতেই পরীক্ষা করাইয়া দিমু। রিপোর্টও পাইয়া যাইবেন আগে আগে। তবে টেকার রসিদ পাইবেন না।


সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার পথে দেখা যায়, মানুষের পায়ে চলাচলের রাস্তায় ভ্রাম্যমান দোকান। হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। সেখান থেকে সামনে জরুরি বিভাগে যাওয়ার পথে এদিক-ওদিক অ্যাম্বুল্যান্স পার্কিং করে রাখা। ভবনের ভেতরে ঢুকতেই রোগীদের আর্তনাদ। একপাশে ঢাকা মেডিকেল বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পরিসেবা বুথে রোগী ও স্বজনরা জায়গা না পেয়ে শুয়ে আছেন। অন্যদিনে টিকিট কাউন্টারের পাশে হাসপাতালে সিট না থাকায় রোগীরা জায়গা নিয়েছেন। আরেকটু সামনে যেতেই পরিচালকের অস্থায়ী কার্যালয়ের দুপাশে আউসিইউতে থাকা রোগীদের স্বজনরা বিছানা পেতে অপেক্ষা করছেন। সেখানে এক রোগীর স্বজন আলাউদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, আমার বোন সাত দিন থেকে আইসিইউতে ভর্তি আছে। এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তাররা বলছেন ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে।



তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে আমার বড় বোনের সিজার করা হয়। তারপর থেকে এ সমস্যা হয় এবং ঢাকা মেডিকেলে আনার কথা বলা হয়। এখানে আসার পর ডাক্তাররা জানান, মেয়াদ উত্তীর্ণ বা ভেজাল ওষুধ প্রয়োগে এমনটা হয়েছে। সাত দিন ভর্তি থাকার পর ডাক্তারা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’


জরুরি বিভাগের সামনেই দেখা যায় একজনের হাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অন্যজন ২৫ দিন বয়সী এক শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে যাচ্ছেন। শিশুটির নাকে-মুখে অক্সিজেনের পাইপ লাগান। শরীয়তপুর থেকে ২২ দিন বয়সী ছেলেকে নিয়ে তিন দিন আগে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে আসেন। সমস্যা শিশুর শ্বাসকষ্ট। তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। এখানে সিট নেই, বাইরে অনেক খরচ। তাই চিকিৎসা না করাতে পেরে বাধ্য হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন।


শিশুটির বাবা মো. আব্দুল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, ‘গত তিন দিন থেকে আমরা হাসপাতালে আছি এভাবে অক্সিজেন লাগিয়ে। ডাক্তারা বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইসিউইতে রাখতে হবে। অনেক চেষ্টার পরও আমরা আইসিইউতে সিট পাইনি। বলে খালি নাই। অনেক সিরিয়াল আছে। বেসরকারি হাসপাতালে রাখতে বলে। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, কৃষি কাজ করে খাই, বেসরকারিতে ভর্তির টাকা কই পামু। তাই বাধ্য হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে বাড়ি চলে যাচ্ছি।’



ময়মনসিংহ ফুলপুর থেকে এসেছেন মো. আজমল মিয়া। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ৫ দিন যাবৎ হাসপাতালে আইছি নাতিরে নিয়ে। ওর রানের কাছে খুব ব্যথা। নাভির ওখানে সুচ দিয়ে ইনজেকশন দেয় প্রতিদিন। তিন-চার খানে সুই দিয়ে রক্ত বের করে ফেলছে। খালি ইনজেকশন দিতাছে, কি হইছে কিছু বলে না, বলে সময় লাগবে।


তিনি বলেন, আমরা রোগী নিয়ে আইছি ডাক্তাররা শুধু পরীক্ষা দিতাছে। পরীক্ষা আর শেষ হয় না। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। আমরা গরিব মানুষ চিকিৎসার জন্য আইছি। কিন্তু সব জায়গায় দালালে ভরা। হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো যায় না, খালি বলে কি লাগব কন, করে দিতাছি। এসব কাজের জন্য আল্লাহ সবার বিচার করব।


মোহাম্মদ রসিদুল ইসলাম রাজধানীর জিগাতলায় বিজিবি ৪ নম্বর গেইটের পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনের ১৩ তলা থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন। তাকে নিয়ে তার সহকর্মীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে এসেছেন। চিকিৎসকরা দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।


তার সহকর্মী নূর মোহাম্মদ বলেন, কাজের সময় হঠাৎ রশি ছিঁড়ে পড়ে যায়। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকার কারণে হাসপাতালে আনতে আনতে দেরি হয়ে যায়।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের সামনে রোগীকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে আসছেন একজন নারী। তিনি রোগীকে নামিয়ে ১০০ টাকা দাবি করছেন। তাদের সাথে কথা বলতে গেলে হুইলচেয়ার নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েন। এ নিয়ে রোগীর মা আনোয়ারা বেগম বিবার্তাকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসে আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। সরকারি হাসপাতালে সকল সেবা বিনামূল্যে করার কথা থাকলেও সব জায়গায় টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কেউ কিছুই করতে চায় না। এখান থেকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১০০ টাকা নিছে। আবার আনার জন্য ১০০ টাকা। কম দিলে আনতে চায় না, বলে চেয়ার নেই।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকিটের জন্য সকল কাউন্টারে তিনটি লাইন। নারী, পুরুষ ও স্টাফদের জন্য। টিকিটের জন্য দুটি লাইনে সাধারণ মানুষের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। আবার ডাক্তার দেখাতেও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেকে অসহ্য হয়ে তাড়াতাড়ি করতে দালাল ধরেন। দালালরা স্টাফদের সাথে মিলে এসব কাজ করেন। বেশি টাকার বিনিময়ে আগে দেখানোর ব্যবস্থা করে দেন।


লালমনিরহাট থেকে বাবাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসে বিড়ম্বনায় পড়েছেন মো. সানোয়ার রহমান। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ‘কালকে রাতে রওনা হইছি বাবাকে নিয়ে, লিভার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। রংপুর মেডিকেল থেকে ডাক্তার ঢাকা মেডিকেলে পাঠাইছে। কিন্তু এখানে আসার পর কয়েকটা টেস্ট দিছে। যার মধ্যে একটা বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে করতে হইছে। এছাড়াও সকল ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হইছে।’


তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তির সময় বেড নেই বলল, যখন কিছু টাকা দিলাম তখন একজন আমার বাবার জন্য বেড ব্যবস্থা করে দিলেন। মূলকথা টাকা ছাড়া এই হাসপাতালে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। অনেকে চিকিৎসা করাতে না পেরে রোগীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।



হাসপাতালের বাইরে ট্রলিতে করে রোগীর বদলে কিছুক্ষণ পরপরই ময়লার ড্রাম ঢেকে এদিক-সেদিক নিয়ে যাচ্ছেন স্টাফরা। আবার ময়লা রেখে আসা সেই ট্রলিতে করে রোগীও বহন করছেন।


এ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম বিবার্তাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে পরিচালক স্যারের সাথে কথা বলেন।’


সেবা নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগ, দালালের দৌরাত্ম্য ও অন্যান্য বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হক বিবার্তাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা আমাদের অভিযোগ করে না কেন? আর এসব বিষয়ে কথা বলতে অনেক সময় লাগবে, অনেক জানার বিষয় আছে। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি সামনা-সামনি আসেন, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।’


নাজমুল হক বলেন, অভিযোগের সঠিক তথ্য থাকতে হবে, তার সাথে ভুক্তভোগীরা থাকলে ভালো হয়। তাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নিব।’


অ্যাম্বুলেন্সের গ্যারেজে মরদেহ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘আপনি এটি নোট রাখেন, পরে দেখা হলে এটা নিয়েও কথা বলব।’


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com