জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও জানা নেই নির্বাচন কমিশনের!
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩, ১০:০৮
জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও জানা নেই নির্বাচন কমিশনের!
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপে প্রায় প্রতিদিন এবং মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক জীবনধারায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় একটি নথি হলো স্মার্ট আইডি কার্ড বা এনআইডি। দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০৮ সালের ২২ জুলাই থেকে। ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর থেকে চালু হয় ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত স্মার্ট আইডি কার্ড। ২০২০ থেকে শুরু হয়ে গেছে এর অনলাইন সেবাও। অনলাইন থেকেই আবেদন সহ স্মার্ট আইডি কার্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যায়।


কিন্তু কহুব আশ্চর্যের বিষয়, এই অতি প্রয়োজনীয় এনআইডি পেতে বা ভুল সংশোধনে মানুষের ভোগান্তি অকল্পনীয়।


এনআইডি পেতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয় বিবার্তা প্রতিবেদকের। কারো নিজের নামে ভুল। কারো বাবার নামে ভুল বা কারো মায়ের নামে। এসব ভুলে অনেকের মাস, বছর পার হলেও গতি হয়নি কোনো। অন্যদিকে বিশেষ রেফারেন্স বা দালালের শরণাপন্ন হলে এসব কাজ নিমিষেই হয়ে যায়।


নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইং ঘুরে দেখা যায়, সবাই ব্যস্ত কোনো না কোনো কাজে। প্রত্যেক কর্মকর্তাই বলছেন তারা ফাইলের চাপে দিশেহারা।


তবে সেবাগ্রহণকারীরা বলছেন, তারা কোনো কাজ সময় মতো করাতে পারেন না। কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই যায়। নিজে নিজে কাজ করতে গেলেই ঝক্কিই বেশি বলে অভিযোগ করেন।


ঢাকার ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আলী বিবার্তাকে বলেন, তাদের কাছে আমি ইমেইল থেকে সব কিছু করলাম কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি- তা হলে এখন আমি কি করব। ১০৫ থেকে শুরু করে যেখানে যা বলছে আমি সেই খানে চেষ্টা করছি কিন্তু হাল ছাড়ি নাই। চেষ্টা করে যাচ্ছি।


আমি পাসপোর্ট করতে পারতাম আপনারা একটু সাহায্যে করলে। তাদের কানে এসব গেলে তো। তিনি আরো বলেন।


নোয়াখালীর মোস্তফা মাহি বিবার্তাকে বলেন, আমি ৭ মাস আগে জরুরি প্রয়োজনে এনআইডি কার্ডের জন্য আবেদন করি এরপর ফিঙ্গার প্রিন্ট দেই। ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েছি আজ ৭/৮ মাস হলো, কিন্তু এখনো মেসেজ আসতাছে না।


অপরদিকে যারা ১/২ মাস আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিছে তাদেরও অনেকের চলে আসে, ইউনিয়ন পরিষদে বলছি উনারা বলে আমাদের হাতে কিছু নেই, ভাগ্য খারাপ তোমার কি করবা অপেক্ষা কর। এদিকে আমার জরুরি প্রয়োজন আইডি কার্ডের।


সবুজ সাহা নামে একজন বিবার্তাকে বলেন, ডকুমেন্ট সব কিছু দেয়ার পরও এনআইডি সংশোধন আবেদন বাতিল করে দেন! এর নামই বাংলাদেশের সিস্টেম। জঘণ্য সিস্টেম। জঘণ্য সরকারি কর্মচারী।


অন্যদিকে মোহাম্মদ শরীফ নামে আরেকজন বিবার্তাকে বলেন, আমি ডকুমেন্টস না থাকায় ৫ মাস ঘোরাঘুরি করেও সমাধান পাইনি৷ পরে এক দালালের মাধ্যমে ৮৫০০ টাকা দিয়ে দুই দিনে করে নিছি।


এনআইডি সংশোধনে আবেদনগুলো চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি আবেদন ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ এ চার ক্যাটাগরির যেকোনো একটিতে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এনআইডি সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদনের পর সংশ্লিষ্টরা ধরন অনুযায়ী এসব ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দিচ্ছেন।


নাম সংশোধনের মতো ছোটখাটো আবেদন করলে সেটি ‘ক’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাই এটি সংশোধন করতে পারেন।


এসএসসি সার্টিফিকেটের সঙ্গে মিল রেখে বয়সের সংশোধন আবেদন ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নিজস্ব ক্ষমতাবলে এটি সংশোধন করতে পারেন।


নামের আমূল পরিবর্তন ও বয়স কম বা বেশি— এমন সংশোধনের আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। এ ক্যাটাগরির আবেদনটি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও এনআইডি হেড অফিসের দুজন পরিচালকের তদন্ত শেষে সংশোধনের এখতিয়ার রয়েছে।


এর বাইরে আরও জটিল আবেদন অর্থাৎ এসএসসি পাস ছাড়া জন্মনিবন্ধন ও অষ্টম পাসের সার্টিফিকেট দিয়ে এনআইডি সংশোধন করতে চাইলে তা ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। এসব আবেদন তদন্ত রিপোর্টসহ এনআইডি মহাপরিচালক সংশোধন করে থাকেন।


একজন মহাপরিচালক, সারাদেশে ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, ৬৪ জন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং উপজেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তা এনআইডি সংশোধনের আবেদনগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী সংশোধন করে থাকেন।


ইসি কর্মকর্তারা বিবার্তাকে জানান, ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যারা ভোটার হয়েছেন, এমন কয়েক কোটি ভোটারের দুই নম্বর ফরম ইসির অনলাইনে নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ফেলে রাখা এসব ফরমের বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। ওই সময় ভোটারদের পূরণ করা ইসির দুই নম্বর ফরমটির বেশির ভাগই এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ইসির অপারেটররা এনআইডিতে ভুল লিখলেও সেটা চেক করার সুযোগ থাকছে না। এনআইডির ভুল সংশোধন করতে এসে উল্টো আরও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ।


এনআইডি শাখা বিবার্তাকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র দিতে না পারায় তা ফেরত দিতে হচ্ছে। আবার বয়স কমানোর আবেদনের ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের জন্য এনআইডি মহাপরিচালকের কাছে পাঠাতে হয়।


নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আলমগীর বলেছেন, দ্বৈত ভোটার হলে অনেক কঠিন শাস্তি। এজন্য জেল খাটতে হবে।


রোববার (১৫ জানুয়ারি) নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।


মো. আলমগীর বলেন, ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবছর মার্চ মাসে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করি। এবারও তাই হবে। যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে, তারা আপত্তি দেবেন। ত্রুটি থাকে তাহলে সংশোধনের জন্য আবেদন করবেন। পরে আমরা চূড়ান্ত করে ভোটার দিবসে তা প্রকাশ করব।


সম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নিতে নাগরিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। কর্মকর্তাদের জনসেবা দিতে গিয়ে প্রভুর মতো আচরণ না করে সেবক হিসেবে কাজ করারও তাগিদ দেন তিনি। সিইসি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন অপরিসীম। এনআইডিতে ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ভুল সংশোধন নিয়ে অনেকেই আসছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের সেবক হিসেবে কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে।


মহাপরিচালক ফোনে বিবার্তাকে বলেন, মানুষের ভোগান্তি যাতে না হয় সেজন্য তারা নিয়মিত তদারকি করেন। কাজগুলো যাতে আটকে না থাকেন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকেন।


টাকার বিনিময়ে বা দালালের মাধ্যমে দ্রুত এনআইডি পাওয়া যাচ্ছে৷ এমন অভিযোগে তিনি বলেন, আমার এ ব্যাপারে জানা নেই, তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে যদি এত ভোগান্তি পোহাতে হয়, তবে স্মার্ট বাংলাদেশ সত্যিই কি আসবে আমাদের হাতের নাগালে?


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com