জাতীয়
‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’
রেলে অনিয়ম কি আসলেই কমছে?
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫০
রেলে অনিয়ম কি আসলেই কমছে?
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের নিকট থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে সম্প্রতি নতুন করে তিনটি সেবা অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা গত ১ মার্চ থেকে কার্যকরও হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’- কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রেলওয়ের টিকিটিং ব্যবস্থায় স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সরকারি উদ্যোগের অংশ এটি।


নতুন এই ব্যবস্থায় গত ১৫ দিনে দেশের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে টিকিট কালোবাজারি কতটা কমেছে কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিই বা কতটা কমেছে?



এসব বিষয়ে জানতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা সরেজমিন ঘুরে গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ ছাড়া কেউ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারছেন না। তবে টিকিট না কেটেও অনেকে টিসি (টিকিট চেকার)-কে ম্যানেজ করে রেলে ভ্রমণ করছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা অনেকেই টিকিট না দেখিয়ে রেল কর্মকর্তাদের 'উৎকোচ' দিয়ে স্টেশন প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।


তবে রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি ছাড়া টিকিট কাটা ও ভ্রমণ না করতে পারায় কালোবাজির একেবারে কমে গেছে। কেউ অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ভ্রমণ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ট্রেন দেরিতে পৌঁছানোর ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আর টিকিট ছাড়া ভ্রমণকারীদের অনিয়মে যারা সহযোগিতা করছেন তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।


গত ১ মার্চ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটিং ব্যবস্থা, টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পস (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিন প্রবর্তন এবং অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়কৃত টিকিট অনলাইনে রিফান্ডের ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই নিয়মে একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে অন্য কেউ ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবে না। অন্যের টিকেটে ভ্রমণ করলে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।


বুধবার (১১ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এ প্রতিবেদক কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা ঘুরে পেয়েছেন এর ভিন্নচিত্র। টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করছেন অনেকে, আবার টিকিটি ছাড়া ট্রেনে কমলাপুর এসে রেলওয়ে কর্মচারীদের সহায়তায় প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরও হয়ে যাচ্ছেন অনেকে।


সকাল পৌনে ১১টায় কমলাপুর থেকে কিশোরগঞ্জ ছেড়ে যায় কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস। সাড়ে ১০টায় ৩ নম্বর প্লাটফর্মে থেমেছিল ট্রেনটি। এসময় বেশ কয়েকজন যাত্রীকে বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করতে দেখা যায়। এর মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিবার্তাকে বলেন, এনআইডি না থাকায় রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। একজনের (ট্রেনের) সাথে কথা বলেছি। ক্যান্টিনে (প্যান্ট্রি কার) করে কিশোরগঞ্জ যাব।


১০টা ৪০ মিনিটের দিকে কমলাপুর স্টেশন প্লাটফর্মে ঢোকে একটি ট্রেন। সেই ট্রেনের অন্তত ৬ জন যাত্রী বিনা টিকিটে ঢাকায় আসেন। প্লাটফর্মে বসার জন্য নির্ধারিত যে জায়গা রয়েছে সেখানে ১০টা ৪৮ মিনিটে তাদের গতিরোধ করেন রেলওয়ে কর্মচারী কয়েস। তার সাথে রয়েছে ওয়াকিটকি। রেলের এই কর্মচারীর সাথে প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছয়জনকে ২০০ টাকায় চুক্তি করতে দেখা যায়। পরে তাদের বর্হিগমন গেটের কাছে নিয়ে যান কয়েস। দুই দিকে আলাদা করে ছয়জনকে পার হয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি। এসময় একপাশ দিয়ে তিনজন বেরিয়ে গেলেও বাকী তিনজনকে আটকে দেন এক আনসার সদস্য। এসময় কয়েস আনসার সদস্যকে কিছু একটা বলে টিকিটবিহীন বাকি যাত্রীদেরও পার করে দেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও বিবার্তার কাছে সংরক্ষিত আছে।


অনলাইনে টিকিট কাটা কতটা সহজ হলো?


কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেলের টিকিট কেনার জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) করা যাত্রীরা সহজেই পাচ্ছেন টিকিট। নিবন্ধন ছাড়া অনেক যাত্রীকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। তবে সবমিলিয়ে ভোগান্তির পরও নতুন ব্যবস্থায় টিকিট পাওয়ায় খুশি যাত্রীরা। তারা বলছেন, ‌'টিকিট যার, ভ্রমণ তার' এ নিয়ম চালু থাকলে টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে। তবে সেবার মান বাড়াতে সময়মতো ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করা দরকার।


সকাল ১০টার দিকে স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করেননি এমন যাত্রীদের জন্য স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের কাছে স্থাপন করা হয়েছে হেল্প ডেস্ক। সেখানে সেবা দিচ্ছেন রেলওয়ের দু'জন কর্মচারী। অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনে তারাকান্দি যাবেন জামিল হোসেন (৪৩)। ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য আগে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করেননি তিনি। জামিল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। কাউন্টারে আগে তো এমনিতে টিকিট কাটা যেত। এখন নাকি আগে রেজিস্ট্রেশন করা লাগে। এজন্য এনআইডি কার্ড নিয়ে এসেছি।


হেল্প ডেস্কে থাকা তুহিন বিবার্তাকে বলেন, প্রতিদিন শত শত মানুষ রেজিস্ট্রেশন করছেন। কেউ শুধু এনআইডি কার্ড নিয়ে আসলে আমরা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যেমে রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছি।


তবে রেজিস্ট্রেশন করেও অনলাইনে টিকিট কাটতে পারছেন না এমনও অনেকে রয়েছেন। চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে কাটতে ব্যর্থ হয়ে কাউন্টারে গিয়েছিলেন আবু সাঈদ খান। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ওয়েবসাইট, অ্যাপস কিছুতেই টিকিট কাটতে পারছি না। কাউন্টারে গেলে বলছে- হেল্প ডেস্কে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে এখানে এসেছি। তারা বলছে, অ্যাপস ডিলিট করে নতুন করে চেষ্টা করার জন্য। আগে একবার ডিলিট করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। এখানে (হেল্প ডেস্কে) প্রযুক্তি রিলেটেড সাপোর্ট রাখলে ভালো হত।


রবিবার (১২ মার্চ) সিলেট যাওয়ার জন্য অনলাইনে টিকিট কাটার চেষ্টা করেছিলেন খালিদ হোসেন। টিকিট থাকার পরও অনলাইনে তিনবার চেষ্টা করে টিকিট কাটতে পারেননি তিনি। খালিদ বিবার্তাকে বলেন, অনলাইনে একবার সিট কনফার্ম করার পর ১৫ মিনিটের ভেতর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আমি তিনবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। প্রত্যেকবার সর্ব্বোচ্চ ২-৩ মিনিট সময় নিয়েছি। কিন্তু স্ক্রিনে দেখায় টাইম লিমিট ক্রস করেছি। চতুর্থবার নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নিলেও টিকিট পাইনি। পরে নগদের হেল্প লাইনে যোগাযোগ করি। তারা অভিযোগ নিয়ে দেখছে বলে জানায়। কিন্তু ৪৮ ঘন্টা পার হলেও টাকা রিফান্ড করেনি।


এ বিষয়ে জানতে কল দিলে নগদ কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের খায়রুল নামে একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, এ বিষয়ে আমরা নির্দিষ্ট কোন সময় দিতে পারব না। অভিযোগের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কনসার্ন আছে। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।



যা বলছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা:


কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. আফছার উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের এখন ট্রেন ডিলে (দেরি) নাই। নানামুখী কারণে কিছুটা ডিলে হলে আমরা সেটাও কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। চালু হলে ট্রেনে ডিলে একদমই থাকবে না।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বিবার্তাকে বলেন, টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধসহ টিকিটিং ব্যবস্থায় নতুন করে তিনটি সেবা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকার আইন করেছে আইন মানার জন্য। কেউ আইন না মানলে জরিমানা করতে হয়। আমাদের দায়িত্ব টিকিট দেয়া, আমরা সেটি ঠিকভাবে করার চেষ্টা করছি।


তিনি বলেন, যারা কালোবাজারি করত, টিকিট মধ্যস্থায় সুবিধাভোগী ছিল তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এ নিয়ম চালু করায় সাধারণ মানুষ মারাত্মকভাবে খুশি, সন্তুষ্ট।


রেলওয়ের কর্মচারীদের অনিয়ম করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দু'একজন বাজে লোক থাকে। টিকিট ছাড়া কেউ যদি কাউকে ভ্রমণে বা প্লাটফর্ম থেকে বের করতে সহযোগিতা করে থাকে এমন কোনো প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com