বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা: কী করছে সরকার!
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩, ১০:০৭
বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা: কী করছে সরকার!
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

মার্চ মাসের প্রথম ১২ দিনের মধ্যে এগারো দিনই বিশ্বের শীর্ষ ১০ দূষিত শহরে তালিকায় ছিল ঢাকা। এর মধ্যে আবার চারদিনই বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহর ছিল রাজধানী। এদিকে চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে ছিলেন। জানুয়ারি মাসে মোট নয়দিন রাজধানীর বায়ুর মান ছিল ‌'অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর'। জানা গেছে, যা বাংলাদেশে গত সাত বছরের জানুয়ারির তুলনায় সবচেয়ে বেশি।


এদিকে, বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা বলছে- রাজধানীতে বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প ও ব্যাপক যানবাহনের কারণে শহরের দূষণ বাড়ছে। এর পাশাপাশি ঢাকার আশেপাশের ইটভাটার ধোঁয়া দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে দেশের জিডিপি'র ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছে বাংলাদেশিরা। দূষণে বিপর্যস্ত রাজধানীর মানুষের মধ্যে বাড়ছে রোগ।



বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বায়ুদূষণ রোধে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায়ও এ অভিযান চলছে। যার কারণে দিনদিন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সামনের দিনে বায়ু মানের আরো উন্নতি হবে।



জানা যায়, বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণের একককে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। একিউআই-এর মান সর্বনিম্ন ০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০। সাধারণত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান ৫০-এর নিচে হলে তা নিরাপদ বায়ু বোঝায়। ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' আর ৩০১ থেকে ৪০০ এর এর মধ্যে থাকা একিউআইকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।


দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুমান নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদফতর। রবিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দেশের ১১টি শহরের ডেইলি একিউআই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, এর মধ্যে দু'টি শহর ছিল রেড জোন অর্থাৎ 'খুব অস্বাস্থ্যকর'। ঢাকা শহরের একিউআই ছিল ২১৮। যা একিউআই ক্যাটাগরিতে ‌'অস্বাস্থ্যকর'।



সুইস বায়ুমান পর্যবেক্ষক সংস্থা আইকিউএয়ারের শহরভিত্তিক এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) রবিবার ঢাকার একিউআই ছিল ১৬৫। এদিন বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দশম দূষিত শহর।



পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের ৩টি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলোবালি। সাধারণত বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি- এই চার মাস ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত থাকে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান ছিল সবচেয়ে বেশি খারাপ।


বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বায়ুদূষণ রোধে ফেব্রুয়ারি মাসে ১ তারিখ থেকে বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। সেই সঙ্গে হাইড্রলিক হর্ন তথা শব্দদূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশনা দেয়া হয়।


এরপর থেকে পরিবেশ অধিদফতরের বর্তমানে কর্মরত তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের দু'জনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের বিরুদ্ধে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা কার্যক্রম শুরু হয়।


জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিশাখা) শামিমা বেগম বিবার্তাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ু দূষণ রোধে আমাদের তৎপরতা চলমান আছে। বায়ু দূষণ রোধে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে।


তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণবিরোধী অভিযান ও পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট উইং, ঢাকা মহানগর কার্যালয়, ঢাকা জেলা কার্যালয়, গাজীপুর জেলা কার্যালয় ও জেলা প্রশাসন ঢাকার উদ্যোগে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এধরণের অভিযান চলমান থাকবে।


২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষকরা বলছেন, দূষণের কারণে গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছে বাংলাদেশিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেয়া বায়ু দূষণের সীমা প্রয়োগ করে হিসাব করা হয়, তাহলে দেশে মাথাপিছু গড় আয়ু ৬ বছর ৯ মাস করে কমছে। আর কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা এতই বেশি যে সেখানে গড় আয়ু কমার পরিমাণ ৯ বছর।


বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজেদের নির্ধারিত সীমা এবং ডব্লিউএইচওর সীমা- দুটোই অতিক্রম করে গেছে। গবেষকেরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিশু ও প্রসূতির অপুষ্টির কারণে গড় আয়ু প্রায় দেড় বছর কমে যাওয়া এবং ধূমপানের কারণে গড় আয়ু দেড় বছর কমে যাওয়ার সঙ্গে বায়ু দূষণে গড় আয়ু কমার তুলনা টেনেছেন।


ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এই বায়ু দূষণ জীবনকাল সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে ৮ বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন। চট্টগ্রামে আয়ু কমছে সাড়ে ছয় বছর করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সবকটিতেই বাতাসে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ডব্লিউএইচওর সহনীয় সীমার বেশি।


এদিকে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে এক প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক জানিয়েছে, বায়ু দূষণের প্রভাবে দেশে ২০১৯ সালে অন্তত ৭৮ হাজার ১৪৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানল হয়।


‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন আরো বলা হয়, বায়ু দূষণের দিক দিয়ে দেশের সবচেয়ে দূষিত বিভাগ ঢাকা। বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প ও ব্যাপক যানবাহনের কারণে এই দূষণ হচ্ছে। সেইসঙ্গে ঢাকার আশেপাশের ইটভাটার ধোঁয়া দূষণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।


জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বিবার্তাকে বলেন, আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান আছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের তিনজন এবং জেলা প্রশাসনের ২-৩ জন ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে প্রতিদিনই আমাদের অভিযান চলছে।


এসব অভিযানে পরিবেশ দূষণ কতটা কমিয়ে আনা গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা শহের আগের চেয়ে বায়ু এখন ভালো। কি জন্য ভালো? আগে (দূষিত শহরের তালিকায়) এক নম্বরে ছিল ঢাকা, এখন তো নেমে আসছে। সামনে আরো উন্নতি হবে।


এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা দীপংকর বর বিবার্তাকে বলেন, বায়ুদূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদেরও বলা হয়েছে। বায়ু দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় যাতে স্ব স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে সেজন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে বিশেষ সভা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়ে নিয়মিত বায়ু দূষণ বিরোধী অভিযান চলছে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com