অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়লেও গতি নেই বিচারে
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩, ১০:৩১
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়লেও গতি নেই বিচারে
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়লেও গতি নেই বিচারে। তাই নতুন ঘটনাগুলোতেও আইনি ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা ও সাধারণ মানুষ।


অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হয়েছে খুব অল্প সংখ্যক। মামলা হলেও বিচারের রায় হয় না বললেই চলে। আগুনের লেলিহান যতদ্রুত মানুষকে পুড়িয়ে মারছে বিপরীতে এসব বিচারকার্য চলছে সর্বোচ্চ ধীরগতিতে।


একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে অগুণতি প্রাণহানির পর অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একাধিক মামলা হলেও বিচার হয়নি। আবার অনেক ঘটনার মামলাই হয় না। ফলে যাদের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে তারা থাকছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।


বিভিন্ন সময়ে আলোচিত অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মামলাগুলো দুর্বল ধারায় করার পাশাপাশি তদন্তকার্য চলে ধীর গতিতে। এমন এমন ঘটনা আছে দায়ীরা চিহ্নিত হলেও তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।



গত একযুগের বেশি সময় ধরে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কোনোটিরই বিচারও শেষ হয়নি এ পর্যন্ত। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের এক হিসাব মতে, গত এক বছরে দেশে ১৬ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর অধিকাংশ ঘটনায় মামলা হয়নি, যেসব ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে, তার কোনো ফলাফল মেলেনি।



গত ১৩ বছরে দেশে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টা ৭১ জন, ওই বছরে বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন এবং কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ হন নিহত হন। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে ৫৪ জন এবং একই বছর রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত হন। এ ছাড়া ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর আগুনে ৫১ ব্যক্তি নিহত হন। এই ৯টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শাস্তি হয়নি কারও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্নি-ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। কোনো কোনো মামলার তদন্তও শেষ হয়নি। দু-একটি ঘটনায় বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও তা চলছে ঢিলেঢালা।


নতুন করে যুক্ত হলো আরো অনেকগুলো আগুনের ঘটনা। সময় বলে দিবে এসব ঘটনায় কি হয়, মামলাগুলো কোন পথে যায়। বিবার্তা প্রতিবেদকের চোখে অগ্নিকাণ্ডের কয়েকটি আলোচিত ঘটনার পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো-


তাজরীন ফ্যাশন : এক যুগেও শেষ হয়নি বিচার


আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা যুক্ত করা হয়। মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর এ কে এম মহসীনুজ্জামান। ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ ওই মামলায় চার্জশিট দিলেও গত ১১ বছরে বিচার কাজ শেষ হয়নি। ওই মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। দেলোয়ার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে তিনি এখন মৎস্যজীবী লীগের নেতা।


ভবনটির নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ না থাকায় এবং আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপন মহড়া বলে শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এরপর থেকে আসামিপক্ষের লোকজনের আর্থিক প্রলোভনের কারণে সাক্ষীরা আদালতে হাজির হচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আর সাক্ষীদের মধ্যে দুজন মালিকের পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ঘটনার ৬ বছর পার হলেও শেষ হয়নি মামলার বিচারকাজ।


সাধারণ ডায়েরিতেই বন্দি নিমতলীর ভয়াবহ আগুনের ঘটনা


পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শিশুসহ ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। ২০১০ সালের ৩ জুন ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিমতলীতে লাগা আগুনে ১২৪ জন প্রাণ হারানোর ঘটনায় শুধু বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। এর ভিত্তিতে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলেও জিডির আর তদন্ত হয়নি। নিমতলি ট্র্যাজেডির ঘটনায় মামলা দায়ের না হওয়ায় পার পেয়ে গেছে দোষীরা।


চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড: ৪ বছরেও শেষ হয়নি বিচারের কাজ


চুড়িহাট্টার ঘটনায় চার্জশিট জমা দেওয়ার এক বছর পর বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৪ বছর পার হলেও এখনও শেষ হয়নি বিচার। সম্প্রতি মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। বিচার শুরুর মাধ্যমে নতুন আশা জাগলেও কবে নাগাদ শেষ হতে পারে মামলার বিচার কাজ, তা বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।


সম্প্রতি ওয়াহেদ ম্যানসনের মালিক দুই ভাইসহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুল কাইউম। গত ৩১ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার ৮ম অতিরিক্ত দায়রা জজ সৈয়দা হাফসা ঝুমা। আগামী ১৪ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।


হাসেম ফুডে মর্মান্তিক ঘটনায় বিচারহীনতায় বছর পার


হাসেম ফুড কারখানার ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্তই শেষ হয়নি এক বছরে। ২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকালে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন দেখে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ১৯ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। তারা ওই কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারী।


ওই ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় নিরাপত্তা না থাকাসহ বিভিন্ন অবহেলার অভিযোগ আনা হয়।


পরদিন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও অ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ জুলাই তাদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন। রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করলে জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক।


ঝুলে আছে এফআর টাওয়ারের তদন্ত


সাড়ে তিন বছর ধরে চলছে এফআর টাওয়ারে আগুনে হতাহত ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত।বনানীর এফআর টাওয়ারের নকশা জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ভবনটির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক ও সাবেক রাজউক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেমসহ চার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল। রাজউকের সাবেক অথোরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহমেদ মারা যাওয়ায় তাকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।


দেড় বছর পার মগবাজারে বিস্ফোণের তদন্তে


দেড় বছরে শেষ হয়নি মগবাজারে বিস্ফোণে হতাহতের ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত। রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস মোড়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে রমনা থানা পুলিশ। বিস্ফোরণের ঘটনায় দণ্ডবিধি ৩০৪-ক ধারায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।


এছাড়া ঢাকার মিরপুরে টিআরএস গার্মেন্টস, টুং হাই গার্মেন্টস, কার্ডিয়াল ডিজাইন, পিয়ারলেস নিটওয়্যার, গুলশান ডিসিসি মার্কেট, কারওয়ানবাজার বিসিআইসি ভবন, তেজগাঁও এবং মোহাম্মদপুরে একাধিক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বয়লার বিস্ফোরণে ৫ জন নিহত হয়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীতে ট্যাম্পকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ড নিহত হয় ২৪ জন। এ ছাড়া গাজীপুরের টার্গেট গার্মেন্টস, ইকো গার্মেন্টস, এম এম গ্রুপ পল্লী কনসেশন সোয়েটার লিমিটেড, বিসিক শিল্প নগরীর সিনথেটিকস গার্মেন্টস, যমুনা ফ্যাক্টরিতে ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর আশুলিয়ার জিরাবোর কালার ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এ ঘটনায় পুলিশ মামলা রেকর্ড করেনি।


এ ছাড়া ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানা ও প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় হতাহতেরও বিচার হয়নি।


এখনো তদন্ত চলছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার।


চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কেশবপুর এলাকার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আটজনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী মামলাটি করেন। মামলায় দুর্ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে।


ডিবিসি টেলিভিশনের প্রতিবেদক আদিত্য আরাফাত বিবার্তাকে বলেন, বিস্ফোরণের ধরণ যেন পাল্টেছে! আগে রাস্তায় বোমা বিস্ফোরণে হতাহতের খবর শুনতাম। দেখতাম৷ বোমা বিস্ফোরণের অনেক নিউজও কাভার করেছি। এসব বিষ্ফোরণ হত খোলা রাস্তায় মিছিল মিটিংয়ে, হরতাল-পিকেটিংয়ে। এখন বিস্ফোরণ হচ্ছে ভবনে। বিকট শব্দে ভবন হয়ে যায় চূর্ন-বিচূর্ণ। মুহূর্তে মানুষ পুড়ে মারা যায়। ভবনে এসব বিস্ফোরণের পরে আমরা ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জানতে পারি, গ্যাস লিকেজ, সিলিন্ডার কিংবা এসি বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিককালের কিছু বিস্ফোরণের পেছনে এসব কারণ জানানো হয়েছে। নাগরিক হিসেবে আমার দাবি, বিভিন্ন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো গভীরভাবে তদন্ত হোক।


গুলিস্তানে যে বিস্ফোরণ হয়েছে তা গ্যাস লিকেজ, সিলিন্ডার কিংবা এসি বিস্ফোরণেই হয়েছে--এমনটা মাথায় রেখে তদন্ত করা ঠিক হবে না। মূল কারণ উদঘাটন জরুরি। তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে খতিয়ে দেখা দরকার এমন বিস্ফোরণের পেছনে নাশকতা আছে কি না।


আইনজীবীরা বিবার্তাকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো দীর্ঘদিনেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় আলামত নষ্ট হয়। তদন্ত শেষে চার্জশিট দিলেও বিচার শুরুর পর সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ হতাহতদের বেশিরভাগই শ্রমিক বা ভাসমান মানুষ। এতে বিচার কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হয়।


ভবনের অবকাঠামোগত ত্রুটি, অবৈধ কেমিক্যাল গুদাম বা অবহেলায় বৈদ্যুতিক গোলোযোগের ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত হলে রাজউক, বিস্ফোরক অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আদালতে সাক্ষী দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু এই ধরনের অগ্নিকাণ্ডে এসব সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও অবহেলা থেকে যায়। কারণ তাদেরকে সাক্ষী হিসেবে পাওয়া যায় না।


হাশেম ফুড ফ্যাক্টরি ও সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে আগুন লাগার পর মানবাধিকার প্রতিনিধি হিসেবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিলেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেখা যায়– যাদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা অবকাঠামোগত কারণে অগ্নিকাণ্ড বা হতাহতের ঘটনার পেছনে যারা জড়িত থাকেন তারা আর্থিকভাবে খুবই শক্তিশালী হন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিপক্ষের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে পেরে ওঠেন না। তিনি আরও বলেন, যে কোন ফৌজদারি অপরাধের বিচার করার দায় রাষ্ট্রের। মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তদন্ত, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য উপস্থাপন–সবই করার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। ফৌজদারি মামলার বিচার না হলে, শাস্তি নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্রকেই দায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ শুধু তাগিদ দিতে পারে।


এই আইনজীবী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে কিছু ব্যতিক্রম হিসেবে হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু সরকারি যেসব কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত অবহেলা থাকে তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয় না। তাদের শাস্তি হয় না। তারা শাস্তির ঊর্ধ্বে থেকে যান। দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হয়ত অবহেলায় অগ্নিকাণ্ড এবং অবহেলাজনিত মৃত্যু কমে আসবে।


দক্ষিণ সিটির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, সব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে মূল্যায়নের জন্য নিয়মিত সভা করা হয়। এছাড়া দক্ষিণ সিটির আওতায় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, সেগুলো নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাতে অন্তত দুর্ঘটনার আগে সতর্ক করা সম্ভব হবে। এ সময় তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ারও আহ্বান জানান।


ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বিবার্তাকে বলেন, বিভিন্ন ভবন বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবন মালিকের দায় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাদের তদারকির গাফিলতিতে আমাদের জীবন এভাবে অনিরাপদ ও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনাও অত্যন্ত জরুরি।


আমাদের নগর এলাকাগুলো এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুকূপ। সড়ক-ফুটপাত, মসজিদ-উপাসনালয়, আবাসিক ভবন-শিল্প কারখানা, বাণিজ্যিক ভবন, বিপণী বিতান কিংবা খাবারের রেস্টুরেন্ট—এই নগরে কোনো কিছুই আর নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ড কিংবা ভবন বিস্ফোরণে এই চরম সত্যটা আমাদের এসব নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনের অধিবাসীদের বাইরেও হতাহত হয়েছেন পথচারী, বাসের যাত্রী, রিকশা-ভ্যানের যাত্রী। কেউ কেউ দোকানে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। সবাইকেই নির্মম পরিণতির শিকার হতে হয়েছে।


ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, চুড়িহাট্টার আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস থেকে কোন কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না ওই এলাকায়। ফলে ওইসব এলাকায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তা ঠেকাতে কোনো সংস্থারই পদক্ষেপ নেই।


রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বিবার্তাকে বলেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার তাই করা হবে।


আর কোনো ছাড় নয়। যারা আইন মানছেন না তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।


তিনি আরো জানান, ভবনগুলোতে আগুন নেভানোর নিজস্ব ব্যবস্থা কেমন, মূল সিঁড়ির পাশাপাশি জরুরি বিকল্প সিঁড়ি আছে কি না, পাম্পের কী অবস্থা, লিফট-ফায়ার লিফট, জেনারেটর কক্ষ ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আছে কিনা এসব বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হবে।


রাজধানীতে ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী যেসব বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে শুধু সেসব ভবনের বিরুদ্ধেই অভিযান চলবে শুরুর দিকে। এমনটিই জানিয়েছে রাজউক কর্তৃপক্ষ।


দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট নন এমন অনেকেই ক্যামেরায় মুখ দেখাতে র্ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যান বলে মন্তব্য করে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, ঘটনা ঘটে গেলে দায়িত্ব কার ওপর দিয়ে পার পাওয়া যাবে সেটা নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকি। দুর্যোগ হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে উদ্ধারকর্মীরা যেতে পারে না। কারণ উৎসুক মানুষ সেলফি তোলার জন্য এতই ব্যস্ত থাকে যে, সেখানে খালি করে উদ্বার করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। এটা (উদ্বার কাজ) কি ফায়ার সার্ভিস করবে? নাকি সিটি করপোরেশন, রেড ক্রিসেন্ট, র‍্যাব, পুলিশ করবে? এমনকি যাদের দায়িত্ব না তারাও সেখানে হাজির হয়ে যান।


শুধু সাধারণ মানুষ না, কর্তৃপক্ষসহ। যে কর্তৃপক্ষের সেখানে কোনও দায়িত্বই নেই, সে কর্তৃপক্ষও সেখানে হাজির হয়ে গেলেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা চলছি। সবাই ক্যামেরা পেলে দু'টো কথা বলতে পারলেই মনে করে, দায়িত্ব হাসিল হয়ে গেলো।


ফায়ার সার্ভিসের জরিপ মতে, রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোন ব্যবস্থা নেই। ভবনগুলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণের তালিকাতে রয়েছে।


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com