সাধারণের নাগালের বাইরে ওষুধের দাম!
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৭
সাধারণের নাগালের বাইরে ওষুধের দাম!
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

মোছা. রওশন আরা বেগম। রক্ত শূন্যতা, মাথা ব্যথা, মাংসপেশি ও শরীরে পানি নামাসহ নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। ছয় ছেলে-মেয়ের প্রায় সবাই নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। রওশন আরার প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দাম বাড়ায় এখন সেই ওষুধ কিনতে লাগে সাড়ে সাত হাজার টাকা। এতদিন ওষুধের টাকা মেঝো ছেলে দিত। কিন্তু করোনায় মেঝো ছেলের ব্যবসায় ধস নামে। এরপর থেকে বড় মেয়ে ওষুধ কিনে দিচ্ছেন। ফলে তার পরিবারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।


রওশন আরা বলেন, একদিন যদি ব্যথার ওষুধ না খাই, ব্যথায় দাঁড়াতে পারি না। শুনছি ওষুধের দাম বাড়ছে। ওষুধ না খাওয়া লাগলে ভালো হত।


তার মেয়ে মোছা. শিউলী বেগম বলেন, সব ধরনের ওষুধের দামই বেড়েছে। সরকার কেন নিয়ন্ত্রণ করছে না এসব। আমাদের মতো মানুষের জন্য এটা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে মায়ের ওষুধ কিনতে যে টাকা লাগত, এখন তার অনেক বেশি লাগছে। সবকিছুর দাম বেড়েছে কিন্তু আয় তো বাড়েনি। 



শুধু রওশন আরা নয়, তার মত প্রায় সবাই ওষুধের দাম বাড়ায় চিন্তিত। ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্রের সব ওষুধ কিনতেও পারছে না।



করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে নিত্যপণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওষুধের দাম। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, কাঁচামালের সংকটসহ নানা কারণে দফায় দফায় দাম বেড়েছে ওষুধের। সরকার ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম বেঁধে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। ওষুধশিল্প ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে বাড়তি খরচ লাগছে। সাথে উৎপাদন খরচ মিলে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর তথা সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া দরকার। যেভাবে ওষুধের দাম বাড়ছে, তা নিম্ন ও নিন্মমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনই এটা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। পাশাপাশি দেশে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে না। এতে ওষুধ তৈরিতে খরচ কমবে, দামও সহনীয় থাকবে।


সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মিডফোর্ট, কাকরাইল, শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডিসহ বেশিরভাগ ওষুধের দোকানগুলোতে মানুষের ভিড় লেগেই আছে। রোগী নিজে কিংবা রোগীর স্বজনরা ওষুধ কিনছেন।


বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অনেক ফার্মেসি আবার মানুষ বুঝে গায়ের দামের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করছেন। দাম বাড়তি নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দোকানিরা জানান, এখন সব ওষুধের দাম বেশি। তাদের কিছু করার নেই।


বেশিরভাগ ক্রেতাকে ওষুধের দাম নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়। ওষুধ কিনতে আসা মো. মোস্তফা কামাল বিবার্তাকে বলেন, মেয়ের ঠান্ডা, জ্বর, কাশি হয়েছে। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছে। সব ওষুধের দাম বেশি। আগে যে প্যারাসিটামল সিরাপ ২০ টাকা দিয়ে কিনেছি, এখন তা বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছে। শুধু প্যারাসিটামল না, যে ওষুধগুলা কিনলাম সব ওষুধের দামই বেড়েছে। কি করার আছে বলেন, কিনতে তো হবেই। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।


তিনি বলেন, ওষুধের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে আমাদের মতো মানুষের বেঁচে থাকায় মুশকিল হয়ে যাবে। দ্রুত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা না হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দাম দিয়ে ওষুধ কেনা সম্ভব হবে না।


মাহবুব ক্রিসেন্ট ফার্মেসির মো. মোহাইমিলুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই। প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে দাম বেশির কথা জানতে চাইলে তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই ওষুধের দাম বাড়ান হয়েছে। কোম্পানি তো লস দিয়ে ব্যবসা করবে না।


পপুলার মেডিকেল স্টোরের কর্মী হানিফ মিয়া বিবার্তাকে বলেন, ওষুধের দাম বাড়াটা সবার জন্য সহনীয় সীমার মধ্যে রাখা দরকার। অনেকে ওষুধ কিনতে এসে দাম শুনে অবাক হয়ে যান। নিন্ম আয়ের এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত মানুষ সব ওষুধ একবারে না কিনে অল্প করে কিনছেন।


ধানমন্ডি লাজ ফার্মার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিক্রয়কর্মী বিবার্তাকে বলেন, মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও সহনশীল হওয়া দরকার। আপনি একটা জিনিস দেখবেন, যে ওষুধগুলো মানুষের সবসময়ই লাগে, বেশি দরকার হয়, বেশি চলে, সেসব ওষুধের দাম বেশি বাড়ান হয়েছে। অবশ্য সকল ওষুধের দাম বাড়ান হয়েছে, তবে যেগুলো বেশি চলে, সেগুলোর দাম বেশি বাড়ান হয়েছে। কোম্পানিগুলো যে যেভাবে পারছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে আবেদন করে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে।


ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বিবার্তাকে বলেন, যেসব ওষুধের দাম বাড়ে তা ওষুধ প্রসাশনের অনুমতি নিয়ে বাড়ে। অর্থাৎ যখন ওষুধের দাম বাড়ান হয় তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের আবেদন করে। যদি আমাদের মনে হয় ওষুধের দাম বাড়ান যাবে, তখন আমরা অনুমতি দিয়ে দেই। আমাদের অনুমোদন ছাড়া কোন ওষুধের দাম বাড়ান যায় না।


তিনি বলেন, ওষুধের মধ্যে ১১৭টি সরকার নিয়ন্ত্রিত জেনেরিক। এর মধ্যে ৫৩টির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এর বাইরে অন্য যে ওষুধগুলো আছে সেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসার জন্য সরকারকে ভ্যাট দেয়। এসব বিষয়ে আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা যৌক্তিক মনে করলে অনুমতি দিয়ে দেই।


মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, যখন কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পায়, ডলারের দাম বেড়ে যায়, অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচ দিনকে দিন বেড়ে চলছে। যার কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলো আবেদন করে দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। কারণ প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহণ-সরবরাহ ব্যয়, জ্বালানি তেলের দাম, ডলারের বিনিময় মূল্য এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এলসি খুলতে বেশি খরচ হচ্ছে।


ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আরও বলেন, ওষুধের দাম বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু আমরা তো চাই না ওষুধের দাম বাড়ুক। যেহেতু সরকার জনগণের পক্ষে কাজ করে। আমরাও চেষ্টা করি দাম যতটা কমিয়ে রাখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ওষুধের দাম বাড়ায় গ্রাহকের কাছে বর্ধিত দাম স্বাভাবিক মনে না-ও হতে পারে। আর মূল্যের বিষয়ে অনেক ওষুধের অনেক ধরনের মূল্য আছে। মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে কিছু কিছু ফার্মেসি ওষুধের দাম বেশি নিচ্ছে। আমরা এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।


ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ওষুধের দাম বাড়ার বিভিন্ন কারণ আছে। কিছু কারণ আছে যেগুলো আমাদের নিজস্ব, আবার কিছু কারণ বাইরের। যেহেতু আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেছে, ট্রান্সপোর্টেশন খরচ বেড়ে গেছে। আমরা আসলে কাঁচামার তৈরি করি না খুব একটা- অধিকাংশ দেশের বাইরে থেকে আসে। বাইরে থেকে আসার ফলে দাম বেড়ে যায়। আগে যেটা ১ কেজি ১০০ টাকা ছিল সেটা হয়ত এখন বেড়ে ১৫০ টাকা বা তার বেশি হয়েছে। এখন বিষয়টা হলো আপনি শুধু কাঁচামাল বেশি দামে কিনছেন তা না, জাহাজে করে আনাসহ সকল খরচও বেড়ে গেছে।


তিনি বলেন, আমাদের এখানে এসব আসার পরে আমরা কন্ট্রোলটা এখনও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। সিস্টেম দরকার ছিল আমাদের, একটা ইউনিফর্ম সিস্টেমসহ নানা রকম সিস্টেম। আমরা বিভিন্ন সময় বলেছিলাম, বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার, যারা ওষুধ তৈরি করে, সরকার, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, রোগী- সবাইকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করতে হবে এবং সেই কমিটি নিয়ে বছরে দুবার তারা রিভিউ করবে। যখন দাম বাড়বে তখন ওষুধের দাম বাড়াবে, যখন আন্তর্জাতিকভাবে দাম কমে যাবে তখন দাম কমাবে। এবং এটা ট্রান্সপারেন্টলি যেন হয়, ওষুধ কোম্পানি তো আর লস দিয়ে ওষুধ বিক্রি করবে না। আমরা ওষুধ কোম্পানিগুলোকে লাভ দিব তবে সে লাভটা বিচারিক বা যৌক্তিক হতে হবে।


অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, আমাদের এখানে এটিআই পার্কটা যত দ্রুত সম্ভব চালু করা দরকার। এটিআই হলো একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইনরেডিয়েন্ট। এই পার্কে ৪০টি কোম্পানিকে জায়গা দেওয়া হয়েছে এবং এই কোম্পানিগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও করেছে সরকার। এতকাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা ছিল না বলে সেই জায়গাগুলোতে তারা কোন কাজ করেনি। এখন তো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়ে গেছে তাহলে এখন কেন করবে না? এটার ওপর সরকারকে চাপ দিতে হবে।


কাঁচামালের কারখানা দেশে তৈরি হলে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলেন, আমরা নিজেরাই তখন অনেক কাঁচামাল তৈরি করতে পারব। কাঁচামাল বানালে কোম্পানিগুলোরও লাভ হবে। তাহলে দেশের বাইরে থেকে কাঁচামাল আনতে হলো না। এতে ওষুধ তৈরিতে খরচও কমবে দামও সহনীয় থাকবে।


অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো কাঁচামাল তৈরি করে ওষুধ বানালে মুনাফা কম, অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানি করে ওষুধ তৈরি করলে মুনাফা বেশি। তাই কাঁচামাল তৈরির জন্য কারখানা তৈরিতে
ওষুধ কোম্পানিগুলো তেমন আগ্রহী না। এখন কোম্পানিগুলা আগ্রহী না হলে জায়গা ফেরত দিয়ে দিক। অন্য কোম্পানি যারা আগ্রহী তারা আসবে। সরকারের জায়গা দখল করে রাখার তো কোনো মানে হয় না।


এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবিএম আব্দুল্লাহ্ বিবার্তাকে বলেন, শুধু ওষুধ না, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সকল পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শুধু তাই না, ল্যাবরেটরি খরচ, চিকিৎসার খরচ, হাসপাতালের অন্যান্য খরচ, অপারেশন খরচ সবই তো বেড়েই যাচ্ছে। যদিও এসব বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হচ্ছে।


তিনি বলেন, সকল কিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ, নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের জন্য চিকিৎসা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। অবস্থাটা সত্যিকার অর্থে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।


প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক আরও বলেন, আমার মনে হয় প্রশাসন-মন্ত্রাণালয়ের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত- যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ওষুধের দাম থাকে। যদিও কোম্পানিগুলো বলছে, আমদানিনির্ভর যেসব ওষুধ সেগুলোর জন্য- জাহাজ ভাড়া, কার্গো ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু তারপরও যদি ওষুধের দাম আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করা যায় বা কমান সম্ভব হয়- তাহলে মানুষের চিকিৎসা সহজ হবে। ওষুধের দাম আরও বাড়লে তা সবার জন্য খুবই ভয়াবহ হবে।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com