বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট: আবেদন না করা প্রার্থী পেলেন নিয়োগ!
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১৩
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট: আবেদন না করা প্রার্থী পেলেন নিয়োগ!
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কক্সবাজার 'মেডিক্যাল অফিসার' পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ২০২২ সালের জুন মাসে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরীক্ষায় বসা তো দূরের কথা, আবেদন না করেও ‘অদৃশ্য ক্ষমতাবলে’ মেডিক্যাল অফিসার পদে এক প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।আবেদন না করা প্রার্থীর নিয়োগে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এমন অভিযোগও উঠেছে।


জানা যায়, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কক্সবাজার ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৩৯.০৮-০০০০,০০৯,১১,০০৪.১৯/৪৬৩  স্মারকে মেডিক্যাল অফিসারের একটি পদসহ বিভিন্ন পদে অস্থায়ী নিয়োগের লক্ষ্যে দরখাস্ত আহ্বান করে। ২০২০ সালের এপ্রিলে লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্যকারণ বশত তা পিছিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।


এর মধ্যে ২০২২ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় মেডিক্যাল অফিসার পদে ৮০১ এবং ৮১৭ রোল নম্বরধারী দুইজন প্রার্থীকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। এর পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মৌখিক পরীক্ষাও নেয়া হয়। পরে ১ জুন নিয়োগ কমিটি ‘মেডিক্যাল অফিসার’ মনোনীত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় মেডিক্যাল অফিসার পদে ৮০১ রোল নম্বরধারী ফাতেমা রহমানকে মনোনীত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।



জানা গেছে, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কক্সবাজার প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে ফাতেমা রহমান ওই সময়ে কোনো আবেদনই করেননি। ৮০১ নম্বর রোলে ফাতেমা রহমানকে নিয়োগ দেয়া হলেও মূলত ওই রোল নম্বরধারী প্রার্থীর নাম মো. ওয়াহেদুজ্জামান। তার মোবাইলে লিখিত পরীক্ষার তারিখ সম্বলিত এসএমএসও পাঠায় কর্তৃপক্ষ।



কিন্তু ওয়াহেদুজ্জামান ৪২তম বিসিএস-এ (স্বাস্থ্য) কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের লিখিত পরীক্ষায় অংশই নেননি। ৮০১ রোল নম্বরের এই প্রার্থীকে অনুপস্থিত দেখানোর পরিবর্তে ওই রোল নম্বরে ফাতেমা রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়।


জানতে চাইলে মো. ওয়াহেদুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, লিখিত পরীক্ষায় আমার রোল নম্বর  ৮০১ ছিল। আমার ৪২তম বিসিএসে নিয়োগ হয়ে যাওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি। আবেদন করেছিলাম- এর মাঝে বিসিএস পরীক্ষা হয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট হয়ে যাওয়ার এক মাস পর এক কলিগের মাধ্যমে জানতে পারি ৮০১ রোল নম্বর দিয়ে অন্য একজনকে নেয়া হয়েছে। বিষয়টা শুনে শকড্ খেয়েছিলাম। আমার এডমিট কার্ড, আমার ব্যাংক ড্রাফটে আরেকজন কিভাবে এপ্লাই করবে। নিশ্চয়ই কোন দুর্নীতি হয়েছে।


লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮১৭ রোল নম্বরধারী অপর প্রার্থী ছিলেন ডা. এ. কিউ. এম জিসানুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় ৮০১ রোল নম্বরধারী প্রার্থী মো. ওয়াহেদুজ্জামান লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। সঙ্গত কারণেই তার রোল নম্বর ৮০১ এর পাশে অনুপস্থিত লিখা থাকার কথা। কিন্তু নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফলের ঘ-এর কলামে ‘মেডিক্যাল অফিসার' পদে রোল নম্বর ৮০১ প্রার্থীর নাম মো. ওয়াহেদুজ্জামান এর পরিবর্তে ফাতেমা রহমান। যিনি উক্ত প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি মূলে কোন আবেদনই করেননি।


তিনি বলেন, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও মহাপরিচালক কর্তৃক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কারণে আমি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ পাইনি। মহাপরিচালক ও তার অনুসারীদের যোগসাজশে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৮০১ রোল নম্বরধারী প্রার্থী মো. ওয়াহেদুজ্জামান এর স্থলে আবেদন না করা ফাতেমা রহমানকে প্রায় আড়াই বছর পর হঠাৎ করে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে, প্রচলিত নিয়মনীতি ভঙ্গ করে নিয়োগ প্রদান করেছেন। যা প্রচলিত আইনে সম্পূর্ণ অবৈধ।


ডা. এ. কিউ. এম জিসানুর রহমান জানান, ২০২২ সালের ২৬ জুন লিখিত পরীক্ষায় ৮০১ নম্বর রোলে প্রার্থী কে ছিলেন এমন তথ্য জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন তিনি। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) সনেট বড়ুয়া ইমন ২০২২ সালের ২৪ জুলাই জবাবে জানান, ৮০১ রোল নম্বরধারী মো. ওয়াহিদুজ্জামান নামে কোন প্রার্থী মেডিকেল অফিসার পদে আবেদন করেননি।


তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, ৮০১ রোল নম্বরধারী প্রার্থী মো. ওয়াহেদুজ্জামান মেডিক্যাল অফিসার পদে আবেদনের জন্য সোনালী ব্যাংক, বাজমে কাদেরিয়া শাখা, ঢাকা থেকে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর POD 8024849 এর মাধ্যমে মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট বরাবরে এক হাজার টাকার পে-অর্ডারসহ আবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে আবেদন যাচাই-বাছাই করে মো. ওয়াহিদুজ্জামান এর বরাবরে প্রবেশপত্র ইস্যু করা হয়। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালক শফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত মো. ওয়াহেদুজ্জামানের লিখিত পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও পে-অর্ডারের কপি বিবার্তার কাছে সংরক্ষিত আছে।


এদিকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ডা. এ. কিউ. এম জিসানুর রহমান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) এর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বিবার্তাকে বলেন, ২০১৯ সালে পরীক্ষার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়েছিল। ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে পরীক্ষাটা হয়নি। আমি আসার পরে শুধু পরীক্ষাটা নিয়েছি। আমি আসার আগেই পরীক্ষার এডমিট কার্ড ইস্যু হয়েছিল। তারপর পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। আমি শুধু স্থগিত পরীক্ষা নতুন করে নিয়েছি। সেই পরীক্ষায় দুজন ডাক্তার অংশগ্রহণ করেছেন। পরীক্ষার পর রেজাল্ট হয়েছে, পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এরপর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।


তিনি বলেন, নিয়োগের এক মাস পর তথ্য অধিকার আইন একটি নোটিশ আসে যে, ৮০১ নম্বর রোলধারী ওয়াহেদুজ্জামানের পরিবর্তে ফাতেমাকে দেয়া হয়েছে। আমি তখন ব্যক্তিগতভাবে রেকর্ড খুঁজে দেখলাম ওয়াহেদুজ্জামান নামে যার কথা বলা হচ্ছে তার কোন আবেদন নেই। পরে আমি তা তথ্য অধিকার আইনে জানিয়ে দিয়েছি। পরে তথ্য কমিশনে আপিল করেছে। আমি জানিয়েছি, যদি কোনো অভিযোগ, প্রমাণ থাকে তাহলে আমাদেরকে দিলে আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিব, তদন্ত করব।


সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, তিনি (জিসানুর রহমান) পরে কী করলেন সরাসরি চলে গেলেন তথ্য কমিশনে। আমাদের পক্ষ থেকে তথ্য কমিশনে হাজিরা দিলেও তিনি হাজিরা দেননি। তখন আমরা তথ্য কমিশনেও বলেছি, যে ধরনের অভিযোগ এসেছে এ ধরনের কোনো আবেদন আমাদের কাছে নেই। উনি যদি তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের দেন তাহলে আমরা দেখব। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, শুরুতে আমার কাছে দরখাস্ত দিতে পারত। একই ভাইভা বোর্ডে পরীক্ষা দিয়েছে ওই সময় বলতে পারত। একই রুমে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনে দেড়-দুই মাস লেগেছে সেসময় বলতে পারত। ব্যবস্থা নেয়ার অনেকগুলো সুযোগ ছিল। কেন কীভাবে করা হলো আমি বুঝতে পারছি না।


তিনি বলেন, আমার কাছে শুধুমাত্র পরীক্ষার্থী তালিকা ছিল। সেটার উপর ভিত্তি করে আমি পরীক্ষা নিয়েছি। আগে যে রেকর্ডগুলো ছিল সেগুলো আমি দেখিনি। আবেদনপত্র যাচাই করে দেখেছি এর পেছনে আর আমি যাইনি। সেগুলো তো সিল করা। অন্য কারো নম্বরে এডমিট কার্ড ইস্যু করা বা অন্য কারো নাম বসানো- সেগুলো তো আমার করা ছিল না। এখন অভিযোগের তীরটা আমার দিকে দেয়া হচ্ছে। আমি কাজ করতে গিয়ে খুবই হতাশ হয়ে যাচ্ছি। এত কষ্ট করে এতদূর এসেছি। আমার পক্ষে ডাক্তারের একটা পোস্ট নিয়ে এটা করা যায়। কেউ তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ দিলে তদন্ত করতে পারি। যদি কোন অন্যায় অবিচার হয়ে থাকে সেটা আমি তদন্ত করে দেখতেই পারি।


একটি রোল নম্বর একাধিক নামে ইস্যু হতে পারে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোল নম্বর কারো নামে ইস্যু হয়ে থাকলে একজনের জন্য একটাই হয়েছে। একাধিকবার হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি হয়ে থাকে আমাদের তথ্য প্রমাণ দিলে তদন্ত করে দেখতে পারি। এখনও সময় আছে। দুই বছর বাকি আছে যেকোনো সময় চাকরি যেতে পারে। এখনো পথ খোলা আছে।


নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন শফিকুর রহমান। শফিকুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমি তো ওখান থেকে চলে আসছি। আমি আমার দায়িত্ব বহু আগে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসছি। এখন যিনি আছে তার সাথে কথা বলেন।


এডমিট কার্ড ইস্যুর আপনার সময়ে হয়েছিল- এমনটি জানালে তিনি বলেন, তখন কোন নিয়োগ কার্যক্রম হয়নি। করোনার কারণে সবই বন্ধ ছিল। ওইটার কোন ডকুমেন্ট কোন কিছুই আমার কাছে এখন নেই। প্রায় দুই বছর আগে আমি সবই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। কারা নিয়োগ দিয়েছে, কবে নিয়োগ হয়েছে, কি হয়েছে এসব আমি জানি না। আপনি ওই অফিসে কথা বলতে পারেন। সব ওখানে আছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেডিক্যাল অফিসার পদে নিয়োগ পাওয়া ফাতেমা রহমান বিবার্তাকে বলেন, সে বলেছে তার রোল ৮০১ ছিল। তার ছিল সেটার যদি প্রমাণ দিতে পারে তাহলে আপনি আমাদের নিয়োগ কমিটির সাথে যোগাযোগ করেন। এটা তারা ভালো বলতে পারবে। আমি যে রোল নম্বর পেয়েছি, সে নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা দিয়ে যে প্রসিডিউর মেইনটেইন করতে হয় আমি সেভাবেই এসেছি। অন্যকিছু থেকে থাকলে নিয়োগ কমিটিকে জিজ্ঞেস করেন।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com