বই নিয়ে গুজব, ছড়াচ্ছে কারা?
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩৬
বই নিয়ে গুজব, ছড়াচ্ছে কারা?
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে নিচের কথাগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। কিন্তু কথাগুলোর আদৌ সত্যতা আছে কি? না থাকলে এগুলো কেন ছড়ানো হচ্ছে? কারাই বা ছড়াচ্ছে? আসলে তাদের উদ্দেশ্য কী?



কথাগুলো হলো-



‍'নতুন বছরের জন্য বই প্রস্তুত করা হয়েছে৷ এটা কি মুসলিম রাষ্ট্র নাকি বিধর্মীদের শাসন ব্যবস্থা? ক্লাস টু'র বই থেকে প্রিয় নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দিয়েছে।  ক্লাস থ্রি'র বই থেকে খলিফা আবু বকর এর জীবনী বাদ দিয়েছে। ক্লাস ফোর এর বই থেকে খলিফা ওমর (রা) এর জীবনী বাদ দিয়েছে।  ক্লাস ফাইভ এর বই থেকে নবীজির বিদায় হজ্জের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাদ দিয়েছে, পাশাপাশি সংযুক্ত করেছে 'বই' নামের একটি কবিতা, যা কুরআন বিরোধী।



শুধু তাই নয়, ক্লাস সিক্স এর বইতে সংযুক্ত করেছে 'লাল গরু' নামের একটি গল্প, যা মুসলিমদের বাধ্য করছে গরুকে মা বলে সম্বোধন করতে। পাশাপাশি শিক্ষা দিচ্ছে গরু জবাই করা একটি মহাঅন্যায়। ক্লাস সেভেন এর বইতে সংযুক্ত করেছে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প  ‘লালো’,  যা মুসলিমদের কালী পূজা করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এবং এই ক্লাসের বইতে বেগম রোকেয়া এর ৫টা পর্দা বিরোধী গল্প রয়েছে। যা শিশুদের মনে ছোট থেকেই পর্দার প্রতি অনিহা সৃষ্টি করবে।  ক্লাস এইট এর বইতে আরো সংযুক্ত করা হয়েছে হিন্দুদের রামায়ণ নামের গ্রন্থ, যা সরাসরি মুসলিমদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছে। একজন মুসলিম হিসাবে এই সকল মুসলিম বিদ্বেষী কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।'



এই কথাগুলো ফেসবুকে স্মৃতি রহমান, মো. আল আমিন তালুকদার, মো. মোফাজ্জল আহমেদ মান্নাসহ প্রভৃতি আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে। কপি করা একই পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে। যা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এই আলোচনা শুধু ফেসবুকে সীমাবদ্ধ নয়, পাড়া-মহল্লার ওয়াজ মাহফিল, রাজনৈতিক সভা, সেমিনার থেকে শুরু করে মহান জাতীয় সংসদেও এনিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে যে বিষয় নিয়ে এতো সমালোচনা, নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক ঘেঁটে তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফলে বোঝা যাচ্ছে একটা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, অশুভ শক্তি গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য এসব ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। আর যারা ছড়াচ্ছে, তারা নতুন বই খুলে না দেখেই এই কাজটি অবলীলায় করেই যাচ্ছে।



নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক ঘেঁটে দেখা যায়, অপপ্রচারকারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির বই থেকে প্রিয় নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দেওয়ার কথা বললেও ওই শ্রেণির বাংলা বইয়ে মহানবী (সা.)-এর জীবনী শীর্ষক ‘সবাই মিলে করি কাজ’ প্রবন্ধটি ৭১ পৃষ্ঠায় রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির বই থেকে খলিফা আবু বকর এর জীবনী বাদ দেওয়ার কথা হলেও তা রয়েছে  ৯৯ পৃষ্ঠায়। গুজবে বলা হয়েছে, ক্লাস ফোর এর বই থেকে খলিফা ওমর (রা) এর জীবন বাদ দেয়ার কথা বলে। অথচ এটি নতুন বাংলা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে। ক্লাস ফাইভ এর বই থেকে নবীজির বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাদ দেওয়া হয়েছে, একইসাথে 'বই' নামের কুরআন বিরোধী একটি কবিতা আছে বলে গুজব ছড়ানো হলেও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধটি আছে এবং এখানে ‘বই’ নামের কোন কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।



ক্লাস সিক্স এর বইতে ‘লাল গরু’ নামের একটি  গল্পে মুসলিমদের গরুকে মা বলে সম্বোধন করতে বাধ্য করার তথ্য ছড়ানো হলেও নতুন বই খুঁজে এই গল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্লাস সেভেন এর বইতে ‘লালো’ নামের গল্পে মুসলিমদের কালী পূজা করতে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলা হলেও নতুন বইতে এই নামে কোন গল্পটি নেই। একই ক্লাসের বইতে ৫টা পর্দা বিরোধী গল্প রয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হয়েছে। ক্লাস এইট এর বই নিয়ে অপপ্রচারে বলা হয়েছে, হিন্দুদের রামায়ণ নামের গ্রন্থ সরাসরি মুসলিমদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছে। অথচ পুরোনো শিক্ষাক্রমের ওই বইতে এই নামের কোনো গল্প নেই।



এদিকে নতুন বই নিয়ে ছড়িয়ে পড়া গুজরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা  হচ্ছে বিবর্তনবাদ নিয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবইয়ে থাকা এই বিষয় নিয়ে অপপ্রচার করে বলা হয়েছে যে, মানুষ নাকি বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে।



মতিউর রহমান রাসেল নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, নতুন বইগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চার্লস ডারউইনের অসার তত্ত্ব বিবর্তনবাদ থেকে শুরু করে পৌরাণিক-পৌত্তলিক কল্পকাহিনি দিয়ে সাজানো হয়েছে বইগুলো। মুসলমানদের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে এরা এদেশের মানুষকে ধর্মহীন নাস্তিক-মুরতাদ বানানোর পায়তারা করছে, যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।


ইবরাহীম হোসেন নামের একজন লিখেছেন, বানর থেকে মানুষ সৃষ্টি, এ চিন্তা সুস্পষ্ট কুফর।



বিবর্তনবাদ নিয়ে এই অপপ্রচারের প্রেক্ষিতে এই শ্রেণির বই ঘেঁটে দেখা যায়, বইটির ২৪ পৃষ্ঠার ৮ লাইনে আছে- 'তোমাদের মনে রাখতে হবে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।”



গত পহেলা জানুয়ারি সরকার ঘোষিত বই উৎসব পালিত হয়েছে। এরপর থেকে এবারের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ঘিরে যেন সমালোচনার শেষ নেই। একদিকে শিক্ষার্থীরা বই উৎসবের দিন বিনামূল্যের সব বই হাতে পাননি, অন্যদিকে যারা নতুন বই পেয়েছেন তাদেরও অধিকাংশের বই নিম্নমানের হওয়ার অভিযোগ এসেছে। নতুন বইতে ভুল থাকার অভিযোগও এসেছে।



এ নিয়ে দায় স্বীকার করে ১৬ জানুয়ারি, সোমবার সংশোধনী দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ বছর তিনটি বিষয়ে মোট নয়টি ভুল স্বীকার করে সংশোধনী দেয় এনসিটিবি। এরই প্রেক্ষিতে নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইতে ভুল-ভ্রান্তি, তথ্য বিকৃতি ও ধর্মীয় উসকানি সংশোধনসহ জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে উচ্চপর্যায়ের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ওই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত থাকবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ২৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। এদিকে পাঠ্যবইয়ের ভুলের সংশোধনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২৭ জানুয়ারি, শুক্রবার এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।


নতুন বইয়ে ভুলের দায় স্বীকার করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, যেসব ভুল ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে সেগুলোর সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। আর এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সামনে আরও ভুল বেরিয়ে আসলে সেগুলোও সংশোধন করা হবে। তবে বই নিয়ে একটি অসাধু চক্র অপরাজনীতি করতে নানা গুজব ছড়াচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানটি।


এই বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি যে- অনেকগুলো বিষয় আছে যেগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হচ্ছে। সবার কাছে একটাই আহ্বান জানাই, একটু ভালো করে বইগুলো পড়েন। এই বইগুলো আমাদের নতুন কারিকুলাম অনুসারে ডিজিটাল প্রজেক্টের আওতায় করেছি। কাজেই স্যোশাল মিডিয়ায় যা কিছু পান, তা যাচাই না করে বিশ্বাস করবেন না।  


তিনি বলেন, আমাদের আহ্বান- যাই শোনেন না কেন, যাই দেখেন না কেন, সেটা সরাসরি বিশ্বাস না করে আপনারা যাচাই করে দেখেন। আর যাচাই করার পরে যদি কোন ক্রুুটি পাওয়া যায় আমরা সেগুলো নিশ্চয়ই সংশোধন করব,পরিমার্জন করব। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কোন কিছু যেন বিচার করা না হয়।


জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, বিনামূল্যের নতুন বই নিয়ে কুচক্রী মহল, সরকারবিরোধী শক্তি, জামায়াত-শিবির নানা গুজব ছড়াচ্ছে। এগুলো নিয়ে কী বলব? কিছু বলার নাই!


তিনি বলেন, এবারের নতুন বইগুলো নিয়ে দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উনারা কাজ শুরু করুক। এখন আর কথা নয়। কাজ করার পর যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে সেগুলোর বিচার তো সরকার করবে। আর পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তাও করা হবে।


তিনি আরো বলেন, নতুন বই নিয়ে নানাভাবে অপপ্রচার-গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যা নিয়ে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে দুই/তিনটা ভিডিও দিয়েছি। এ বিষয়ে আরও ভিডিও দেয়া হবে।


নতুন বই নিয়ে গুজবের বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, একদিকে যেমন পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকা কাম্য নয়, অপরদিকে কেউ যদি নতুন বই নিয়ে গুজব ছড়িতে অপরাজনীত করতে চায় সেটাও কাম্য নয়।



এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিবার্তাকে বলেন, আমি বই নিয়ে অনেক কথা বলেছি। এ বিষয়ে এখন আর কিছু বলার নাই। আমার যা যা বলার বলে দিয়েছি। এখন আর খামাখা মন্তব্য করতে চাই না।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে ভুলগুলো হয়েছে অবহেলাজনিত কারণে। তবে পাঠ্যবইয়ে ভুল হওয়া যেমন কাম্য নয়, একইসাথে বই নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোও কাম্য নয়।এটি ভুলের মতো মারাত্মক ঘটনা। আর এসবে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে না, সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।


তিনি বলেন, বইয়ের ভুলের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে আর ভুল সংশোধন করে অতিদ্রুত আবার বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকারও তারা করেছে। ইতোমধ্যে বইয়ের বিষয়ে দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।  এরমধ্যে একটি কমিটি বইয়ের ভুল সংশোধন করবে আর অন্যটি ভুলের পেছনে কারো ইচ্ছাকৃত অবহেলা আছে কি-না সেটি দেখবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বই নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আর এই কার্যক্রম দেখে বোঝা যায় যে, পাঠ্যপুস্তকের ভুলকে সরকারবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। সেই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।


বিবার্তা/ রাসেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com