মানবতার সাধক লালন শাহ
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৫৯
মানবতার সাধক লালন শাহ
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, বাউল সম্প্রদায়, বাউল গান- সবই বাঙালির গৌরব। সেই গৌরবের ইতিহাসের গোড়াপত্তন করেছিলেন লালন সাঁই।


লালন শাহ, মহাত্মা লালন, বাউল সম্রাট, মরমি সাধকসহ একাধিক নাম তাঁর। তিনি তাঁর শিষ্যদের ‘সাঁইজি’। লালন একজন দার্শনিকও। তাঁর গান ও দর্শনের দ্বারা বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিকরাও প্রভাবিত হয়েছেন।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের মৃত্যুর দুই বছর পর তাঁর আখড়াবাড়িতে যান এবং লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন।


লালনকে বিশ্বকবি বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। লালনের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমেরিকান কবি ‘এলেন গিন্সবার্গও’ লালনের দর্শনে প্রভাবিত ছিলেন। তার লেখায় লালনের রচনা শৈলীর অনুকরণ দেখা যায়। লালন সংগীত ও দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।


বাউল সাধক লালন শাহ ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য মতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।


লালন শাহ যৌবনকালে তীর্থ ভ্রমণে বের হলে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সঙ্গীরা তাকে একা রেখে চলে যান। সিরাজ সাঁই নামে একজন ফকির তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। লালন তার কাছে বাউল ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ছেঁউড়িয়ায় আখড়া নির্মাণ করে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস করতে থাকেন।


লালন শাহের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনা বলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।


লালনকে বাউল মতাদর্শ ও বাউল গানের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মমত লৌকিক। বাউলরা আধ্যাত্ম সাধনা, পরমাত্মার অন্বেষণ করেন। তারা মানবতার মর্মবাণী প্রচার করেই জীবন অতিবাহিত করেন।


তিনি মনে করতেন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয় আত্মা। তারা বিশ্বাস করেন আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা সম্ভব। আত্মার বাস দেহে, তাই বাউলরা দেহকে পবিত্র মনে করেন।


লালন সমাজে প্রচলিত ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর মানবধর্মের মতবাদ প্রচার করেন গানের মাধ্যমে। তাঁর গান ও তাঁর অহিংসবাদী মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। প্রায় সব ধর্মেও মানুষ শিষ্যত্ব নেয় লালনের।


ফকির লালন সাঁই তাঁর গানের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন নতুন এক মানবধর্মের চর্চা। তিনি জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ ও মানবতাকে বড় করে দেখেছেন।


তিনি কোনো জাতিভেদ মানতেন না। ধর্ম-বর্ণহীন সমাজের কথাগুলো গানের মূলকথা হওয়ায় মানুষ তাঁর গানের মাধ্যমে মানবমুক্তির আশ্রয় খুঁজে পায়।


সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত সার্বজনীন ভাব-রসে সিক্ত বলে লালনের গান হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়।


লালনের আখড়ায় আজও তাঁর জন্ম ও তিরোধান দিবসে স্মরণোৎসব আয়োজিত হয়। যেখানে এখনও এসব আয়োজনে লোকের সমাগমে আখড়া ভরে ওঠে।


লালন সাঁইজি সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেন,


‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’


লালন সাঁই মনে করতেন, মানুষই সর্বোচ্চ আসনের আসীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মাঝেই এক মনের মানুষের বাস। তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।


তিনি মনে করতেন, সব মানুষের মাঝেই ঈশ্বর বাস করেন। লালন ভক্ত বাউলরা মনে করে, দেহের মধ্যে স্থিত রয়েছে বিশ্বের সবকিছু।


লালনের গান লালনগীতি হিসেবে পরিচিত। তিনি মুখে মুখে গান রচনা করতেন এবং সুর করে পরিবেশন করতেন। এভাবেই তাঁর প্রায় দুই হাজার গানের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে ওঠে।


লালন তাঁর গানে সমকালীন সমাজের নানা কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ, বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি রূপকের আড়ালে তাঁর দর্শন ও উত্তর উপস্থাপন করেছেন।


লালনের জীবদ্দশায় তাকে তেমন কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে দেখা যায়নি। লালন ফকির তাঁর সাধনা বলে তিনি হিন্দু এবং ইসলাম ধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। সব ধর্মের লোকের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।


বাউলদের ধর্ম-সাধনায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য ‘সহজিয়া’ পন্থা বা ‘সহজপন্থা’। ‘সহজিয়া সাধনা’র মূল কথা হলো ‘উজান-সাধনা’।


আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেন। লালনের গানে মানুষ ও সমাজ প্রাধান্য পেয়েছে। আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছেন ও নিজেই গেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, তৎকালীন ধর্মভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অচলাবস্থা ও তা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে সবার আগে মানবধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।


লালন মনে করতেন মানুষের মাঝেই এক ‘মনের মানুষ’-এর বসবাস যার প্রকৃত রূপ সৃষ্টিকর্তা। নিজেকে জানার প্রবল আগ্রহ থেকেই তাঁর বিভিন্ন গানে মনের মানুষের বিভিন্ন রূপ তুলে ধরেছেন। তাঁর গানে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন।


লালনের গানগুলোতে ব্যক্তিজীবনের প্রভাব দেখা যায়। যে সময় লালন তাঁর গানগুলো রচনা করেছেন ওই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ একের পর এক আগ্রাসনে জর্জড়িত ছিল। ফকির লালন সাঁই সবসময় চেয়েছেন যেন মানুষ নিজের সত্তাকে চেনে- ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় বাড়াবাড়িকে উপেক্ষা করে মানবধর্মের পথে চলা সহজ করতে। তাই তিনি বলেন-


‘জাত গেল জাত গেল বলে এ কী আজব কারখানা
সত্য পথে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না।’


লালন শাহ তাঁর বাউল গান ও বাউলতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তথাপিও মানব ধর্মের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ তাকে বারবার প্রেরণা জুগিয়েছে।


লালনের সেই বাউল গানগুলো এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।


১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর, বাংলা ১২৯৭ সালের পহেলা কার্তিক লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেউড়িয়ায় নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি সঙ্গীত ধারনা করেন এবং এক সময় শিষ্যদের বলেন, ‘আমি চলিলাম’ এবং এর কিছু সময় পরই তাঁর মৃত্যু হয়। তারই ইচ্ছা অনুসারে ছেঁউড়িয়ায় তাঁর আখড়ার মধ্যে তাকে সমাহিত করা হয়।


লালন সাঁই প্রয়াত হয়েছেন বহুবছর। তাঁর অনুসারীরা গান দর্শনকে প্রচার করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী লালনের অনুসারীদের নানাভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত করেই চলছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে লালন চর্চা। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে একদিন হারিয়ে যাবে লালন সঙ্গীতের মতো মূল্যবান সম্পদ। তাই আমাদেরকে এই সাম্প্রদায়িকতা রুখতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা লালনগীতি রক্ষা করতে পারব।


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com