শিরোনাম
‘আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে’
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০১৯, ২১:৩১
‘আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে’
মো. আব্দুল মোমেন
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

সময় এখন পরিবর্তনের। সময় এখন বিশ্বায়নের। সময় এখন নিজেকে গড়ার এবং নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের। নিজের শ্রম-মেধা ব্যয় করে হয়ে উঠুন উদ্যোক্তা। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে আপনাকে হতে হবে সৃজনশীল, নিজেকে ভাবতে হবে বাকিদের থেকে আলাদা। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই কাজের ক্ষেত্র তৈরি করুন। উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে নিজেকে বাকিদের থেকে আলাদা করে গড়ে তুলুন। তাহলে দেখবেন আপনিই একদিন দেশের অনেক লোককে কাজ দিতে সক্ষম হবেন।


নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ চায়না বিজনেস ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি এবং চায়না বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কো. লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মোমেন।


সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগস্থ বিবার্তার নতুন অফিসে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।



দীর্ঘ আলাপে উঠে এসেছে একজন উদ্যোক্তার শুরু, কারিগরি প্রশিক্ষণ, চ্যালেঞ্জসহ এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট বিজনেসের বিভিন্ন দিক। তিনি মনে করেন দেশের উদ্যোক্তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারলে দেশে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি আরো উন্নতি হবে। এই উদ্যোক্তরাই দেশে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হবে।


সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ। এর চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।


বিবার্তা: আপনি বাংলাদেশ চায়না বিজনেস ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি। এই ক্লাবের কার্যক্রম সম্পর্কে বিবার্তার পাঠকদের উদ্দেশে কি কিছু বলবেন?


মো. আব্দুল মোমেন: একজন উদ্যোক্তা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বল্প পুঁজি দিয়ে কীভাবে ব্যবসা শুরু করবেন, এর জন্য সঠিক গাইডলাইন ও পণ্য নির্বাচনের উপায়, মাত্র ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কীভাবে লাভজনক এক্সপোর্ট/ইম্পোর্ট ব্যবসা করবেন এসব বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ধারণা দিয়ে থাকি। নতুন উদ্যোক্তারা শুরুতে নানান সমস্যায় পড়েন। তারা বুঝে উঠতে পারেন না কীভাবে ব্যবসার পরিকল্পনা করবেন, ব্যবসার লাইসেন্স করবেন, কোন পণ্যটি এক্সপোর্ট করবেন, প্রোডাক্ট সোর্সিং (দেশি ও বিদেশি মার্কেট), প্রোডাক্ট সিলেকশন ও কোয়ালিটি যাচাই, কস্টিং, শিপিং চার্জ ও ডেলিভারি, প্রোডাক্ট মার্কেটিং, সেলস প্ল্যান (অনলাইন, অফলাইন ও অন্যান্য), সহজ পেমেন্ট সিস্টেম এবং বিদেশি ফাইনান্সিং কোথায় পাওয়া যাবে, এসব বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হয়।


বিবার্তা: যতদূর জেনেছি আপনি ২০১০ সাল থেকে চীনের সাথে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের বিজনেস করছেন। আপনার দৃষ্টিতে দেশের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট খাতের বর্তমান অবস্থা কেমন?


মো. আব্দুল মোমেন: বর্তমানে আমদের দেশটা হচ্ছে ইম্পোর্টনির্ভর দেশ। যেমন- চায়না ইম্পোর্ট করে, আবার এক্সপোর্টও করে। কিন্তু এক্সপোর্টের চেয়ে ইম্পোর্ট কম। তাদের সরকার দেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এমনভাবে তৈরি করেছে যে, তোমরা উদ্যোক্তা হও। এক্সপোর্ট করো। তোমরা বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসো। এটাকে দিয়ে উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে প্রোডাক্ট তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপোর্ট করো। আমাদের দেশে এক্সপোর্টকে উৎসাহিত করা হয় না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ব্যবসাবান্ধব। তিনি ব্যবসাটা বোঝেন। কিন্তু ওনার যে বডিগুলো রয়েছে তারা মার্কেটিং ওরিয়েন্টটেড না। ব্যবসাবান্ধব না। দেশপ্রেমিক না। কিন্তু চায়নাদের চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে পরিবার থেকেই শিশুদের ব্যবসা করার কৌশল শিখিয়ে দেয়া হয়। তাই তারা ব্যবসাবন্ধব হয়ে থাকেন। দেশও এগিয়ে গেছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাহলে আমরাও চায়নার মতো বেশি বেশি পণ্য বিদেশে এক্সপোর্ট করতে পারবো।



বিবার্তা: চীনের বাজারে আমাদের সম্ভাবনার খাতগুলো কি কি?


মো. আব্দুল মোমেন: চায়নারা সব কিছু উৎপাদন করে না। তারা ইম্পোর্টও করে। যেমেন, আমাদের দেশ থেকে চামড়া, গরুর অঙ্গ-প্রতঙ্গ, পাট, মেয়েদের চুল, মাছ, সাপ, ব্যাঙ্গ, কাকড়া এসব প্রচুর পরিমাণে নিচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে কুটিরশিল্পজাত পণ্য এবং তৈরি পোশাক নিয়ে থাকে।


বিবার্তা: বিশ্বায়নের এই যুগে দেশের উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?


মো. আব্দুল মোমেন: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি এবং ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রাইভেট লেভেল থেকে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা তৈরির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা অনেক মেধাবী। তাদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। তাদের মধ্য থেকেই একদিন হয় তো বেরিয়ে আসবে জ্যাক মা, জুকার বার্গের মতো সফল উদ্যোক্তা। তারা কিছু একটা করতে চায়। এর বড় প্রমাণ তারা প্রচুর সময় দেয় অনলাইনে। অনলাইননির্ভর কাজের প্রতি তাদের অনেক আগ্রহ রয়েছে। আইসিটিতে ক্যারিয়ার গড়তে তারা দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করছে, নতুন কিছু করে দেশকে পরিবর্তন করতে চায়। এসব কাজ করতে গিয়ে তারা কখনওবা হোঁচটও খাচ্ছে। আবার তরুণদের জন্য সরকারিভাবে যে সমস্ত সুযোগ তৈরি হচ্ছে তা তারা নিতে শুরু করছে।



বিবার্তা: আমাদের দেশে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি শুরু হলেও বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ব্যর্থ হচ্ছে কেন?


মো. আব্দুল মোমেন: আশার কথা হলো, উন্নত বিশ্বের মতো এখন আমাদের দেশেও তরুণ-তরুণীরা উদ্যোক্তা হতে চায়। সারাদেশে এখন উদ্যোক্তা সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছরে অনেক উদ্যোক্তা তৈরিও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উন্নত বিশ্বেও নতুন উদ্যোগ সফল হয় না। এটা সারাবিশ্বের উদ্যোক্তা সংস্কৃতির একটা ধর্ম। কারণ হলো, একজন উদ্যোক্তা যে জিনিসটা চিন্তা করে বিভিন্ন কারণে সেটা বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। দেশে নতুন কোনো কিছু শুরু হলে নানা সমস্যা, বাধা-বিপত্তি আসবে। যেমন, একজন উদ্যোক্তা প্রথমে যখন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন তার উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে ধরনের প্রয়োনীয় জ্ঞান, গুণাবলী, যোগ্যতা, দক্ষতা নিজের মধ্যে থাকতে হয় সেগুলো থকে না। এছাড়াও যে কোনো উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে দায়ী থাকে ব্যবসার সঠিক পরিকল্পনা না নেয়া এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া।


বিবার্তা: উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?


মো. আব্দুল মোমেন: উদ্যোগের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ধৈর্য্ ধরে এগিয়ে যাওয়া। এছাড়াও আমাদের দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা আসে পরিবার থেকে। তারা কোনো ভাবেই চায় না যে এত রিস্ক নিয়ে তাদের সন্তান উদ্যোক্তা হোক। আমাদের পরিবার সরকারি চাকরির জন্য প্রয়োজনে ছেলে-মেয়েকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চায়, তাহলে ১০ হাজার টাকা দিতেও রাজি হয় না। কারণ চাকরিতে মাস শেষে বেতন পাওয়া যাবে। উদ্যোক্তাদের তো সে নিশ্চয়তা নেই। সেকারণে তারা মেনে নিতে চায় না। পরিবারের পরে আরো বাধা আসে সমাজ, রাষ্ট্রের বিভিন্ন জটিলতাপূর্ণ সিস্টেমের কারণে। আপনি যেকোন কাজ করতে যদি সরকারি কোনো অফিস-আদালতে যান, তাহলেই বুঝতে পারবেন কত রকমের অনিয়ম এবং সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যবস্থা। অন্যান্য উন্নত দেশে আপনি উদ্যোক্তা হলে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্নভাবে ফান্ডিং/লোন/ইনভেস্টমেন্ট এবং অন্যান্য বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে সেগুলো একজন নবীন উদ্যোক্তার জন্য অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ! এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি আছে এবং আসতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।



বিবার্তা: দেশের উদ্যোক্তাদের নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা?


মো. আব্দুল মোমেন: দেশের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ব্যবসার প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান দেয়ার লক্ষ্যে খুব শিগগিরই আমরা একটা এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ চায়না বিজনেস ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতি তিন মাস পরপর উদ্যোক্তাদের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে ধারণা দিতে একটা বিশেষ সেমিনার আয়োজন করে থাকি। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরাতে (আইসিসিবি) ৫ হাজার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা বিশেষ সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই আয়োজনে সারাদেশের উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়াও আমরা ৫ হাজার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা ডিরেক্টরি তৈরি করার পরিকল্পনা করেছি। এখানে কোন উদ্যোক্তা কোন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছেন তা যেন সবাই জানতে পারেন। ওই ডিরেক্টরিটা এমনভাবে তৈরি করা হবে যেখানে একজন উদ্যোক্তা আরেকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেতে বা নিতে পারবেন। সেইসাথে আমরা ৫ হাজার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা ই-কমার্স প্লাটফর্ম তৈরি করব। যেখানে ৫০ হাজার প্রোডাক্ট থাকবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা যাতে এখানে ৫০ হাজার বা ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে, হাতে-কলমে কাজ শিখে এখান থেকে যাতে মাসে ৫০ হাজার টাকা ইনকাম করতে পারে সে পথ তৈরি করে দেব।



বিবার্তা: ভবিষ্যতে দেশের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট খাতকে আপনি কীভাবে দেখতে চাইছেন?


মো. আব্দুল মোমেন: প্রতিনিয়ত আমরা বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল এনে অনেক টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা তো দেশের জন্য ভাল নয়। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে আমাদের রফতানি বাড়াতে হবে। বিদেশি টেকনোলজি এনে ভাল মানসম্পন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করে আমাদের রফতানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। তাহলে বৈদাশিক মুদ্রা আয় হবে। আর যখন আয় বাড়বে তখন দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। এই সম্ভাবনাটা আমাদের আছে। শুধু আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে আরেকটু আন্তরিক হতে হবে।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com