শিরোনাম
‘আইটি প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি থাকতে হবে’
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৪৬
‘আইটি প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি থাকতে হবে’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি মেয়াদে আমরা প্রথমেই যে কাজটি করতে যাচ্ছি সেটা হলো, প্রত্যেকটা প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপির ব্যবস্থা করা। প্রত্যেকটা প্রোডাক্টের গায়ে এটা থাকতে হবে। যারা এ ব্যবসা করবেন তাঁরা যাতে এমআরপি লেখা প্রোডাক্ট বিক্রি করেন এবং ক্রেতারা যাতে আইটি পণ্য কেনার সময় দামের দিক থেকে কোনোভাবে ঠকতে না পারেন, সেই ব্যবস্থাই আমরা করবো। এজন্য ইতোমধ্যেই আমরা আইসিটি, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় একজোট হয়ে কাজ শুরু করেছি।


একান্ত আলাপে কথাগুলো বলেন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) ২০১৮-২০ মেয়াদের নবনির্বাচিত সভাপতি ও সি অ্যান্ড সি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত সরকার।


সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কার্যালয়ে তিনি মুখোমুখি হন বিবার্তার। খোলামেলা আলাপে জানান হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান হালচাল, ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানান বিষয়। বিবার্তা পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।



বিবার্তা : দেশের হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?


সুব্রত সরকার : দেশের আইসিটি সেক্টরের প্রধান ব্যবসায়ী হলেন কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীরা। হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে আমার মূল্যায়ন হলো, এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। তবে ভলিউম অব সেল অনেক বেড়েছে। ভলিউম অব সেল বলতে বোঝাতে চেয়েছি বাজার বড় হয়েছে, কম্পিউটার ব্যবহারকারী বেড়েছে। ব্যবহারকারী বাড়লে কিন্তু অটোমেটিক্যালি বাজার বড় হয়। কিন্তু যদি কম্পিটিশন হিসেব করি তাহলে বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে কিছু অনৈতিক প্রতিযোগিতা (আনএথিক্যাল কম্পিটিশন) আছে। প্রতিযোগিতাটা হচ্ছে যে, আমরা একটা প্রোডাক্টের দাম থেকে সাধারণত কিছু প্রফিট করার চেষ্টা করি। আমার কাছে মনে হয় হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীরা এই প্রতিযোগিতার কারণে প্রোডাক্টের দাম কমাতে কমাতে এমন জায়গায় নিয়ে আসেন, অনেক সময় দেখা যায় যে পারচেজ প্রাইসেরও নিচে চলে যান। এটা আমার কাছে মনে হয় একটা বিব্রতকর অবস্থা।


এ জন্য প্রথমেই আমরা যে কাজটি করতে যাচ্ছি সেটা হলো, প্রত্যেকটা প্রোডাক্টের এমআরপি করা। প্রত্যেকটা প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি থাকতে হবে। যারা এ ব্যবসা করবেন তারা যাতে এমআরপি লেখা প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারেন সে ব্যবস্থা করবো। এর কোনো বিকল্প নাই।


সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু এই লাইনেই আগাচ্ছে। আপনি হয়তো জানবেন ওষুধশিল্প থেকে শুরু সমস্ত জায়গায় কিন্তু ডিসকাউন্ট লাইনটা ওভাবে কাস্টমারদের সাথে এমআরপিতে বিক্রি করা হয়। তাই হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির প্রোডাক্টও এমআরপিতে বিক্রি হবে, এমআরপিতেই কেনাকাটা করা হবে। এটাই হওয়া উচিত। এটাতে সরকারও লাভবান হবে। এতে সরকারের ট্যাক্স বা প্রফিটের একটা বড় কোটা রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেখছি মাক্সিমাম প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি লেখা আছে। কিন্তু কেন জানি আমাদের দেশের ৯০% আইটি প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি লেখা নাই। যে ১০% আইটি প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি আছে তাও মানার চেষ্টা করে না। সেগুলো কমাতে কমাতে এমআরপির আরো নিচে চলে যাচ্ছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতেও প্রত্যেকটা আইটি প্রোডাক্টের গায়ে এমআরপি করা। এমআরপি ছাড়া তারা আইটি প্রোডাক্ট বেচাকেনা করে না।


এ সমস্যাটা সমাধানের জন্য আমরা স্ট্রংলি আইসিটি, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় একজোট হয়ে কাজ শুরু করেছি। প্রত্যেকটি আইটি প্রোডাক্ট যাতে এমআরপিতে বিক্রি হয় এবং প্রত্যেকটা পণ্যে গায়ে যাতে এমআরপি লেখা থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশেষভাবে কাজ শুরু করেছি। এ কাজটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে হার্ডওয়্যার শিল্পের বাজারটা স্থিতিশীল হবে। সেইসাথে মার্কেটে যে আনএথিক্যাল একটা কম্পিটিশন রয়েছে সেটা শেষ হবে। নতুন মেয়াদে আমাদের প্রথম কাজ হবে এই জায়গাটা ঠিক রাখা। এতে ক্রেতারাও আর ভাবতে পারবে না এ পণ্যে বেশি দাম নেয়া হচ্ছে, ওটাতে কম। তখন ক্রেতারাও নিশ্চিত হয়ে যাবে যে এ প্রোডাক্টের মূল্য এটাই। কোনোভাবে ঠকে যাওয়ার আর সুযোগ থাকবে না।



বিবার্তা : এক্ষেত্রে সরকারের কোনো সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে কি?


সুব্রত সরকার : হ্যাঁ, সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সাথে চারবার মিটিং করেছি। কী করলে হার্ডওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হবে সে বিষয়ে মন্ত্রী জানতে চাইলে আমি বলেছি, মন্ত্রী মহোদয় মাত্র তিন-চারটা কাজ যদি আমাদের জন্য করে দেন তাহলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বেঁচে যাবে। আমাদের ব্যবসায়ীরা আর অসুস্থ হবে না।


প্রথমত, টেন্ডারে যে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) আছে সেখানে বলতে হবে যে, যারা কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের প্রোডাক্ট কিনবে তাঁকে অবশ্যই বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির মেম্বার হতে হবে। যদি কেউ সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির টেন্ডার নিতে আবেদন করেন তাঁকেও বেসিসের মেম্বার হতে হবে। অতএব পিপিআর-এর এই জায়গাগুলিতে যদি বিষয়গুলো বসিয়ে দেন তাহলে আমাদের বিসিএস, বেসিস সংগঠনের উন্নতি হবে, মান বাড়বে। আমাদের মেম্বারশীপটা থাকবে এবং ইন্ডাস্ট্রিটা কন্ট্রোল করতে পারবো। আমার মেম্বারের বাইরে একজন ব্যবসায়ীকে কিন্তু আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না। বা টেন্ডার প্রসিডিউরমেন্ট যখন যায় তখন দেখা যায় যে, যারা আইটি ব্যবসা করে না এরকম লোকরাও টেন্ডার পাচ্ছে। পরে যখন সরকার সার্ভিস নিতে যায় তখন দেখে যে ওই কম্পানির কোনো অস্থিত্বই নেই। যখন আমার মেম্বার হবে তখন কিন্তু আমি তার কম্পানির কাগজপত্র দেখেই তাকে মেম্বারশীপ দিচ্ছি। তখন যদি ওই কম্পানি সার্ভিস না দেয় তখন তা দেখার আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। তখন ওই কম্পানিকে খুঁজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবো।


দ্বিতীয়ত, চলতি মাসেই বাংলাদেশে যেসব ইন্টারন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি তাদের প্রোডাক্ট বাজারজাত করছে তাদের সাথেই একটা মিটিং করবো। তাদের প্রোডাক্টগুলো বাজারজাত করার আগে এমআরপি করার কথা বলবো। এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে বলবো আপনি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শুধু একটা সার্কুলেশন দিয়ে বলবেন যে, যেকোনো আইটি প্রোডাক্ট অবশ্যই এমআইপিতে বিক্রি করতে হবে। তাহলেই হলো।


তৃতীয়ত, দেশে প্রতিনিয়ত বাইরে থেকে লাখ লাখ প্রোডাক্ট আসছে। এগুলো আসল না নকল, বা এ প্রোডাক্টগুলো দেশের জন্য ক্ষতিকর কিনা, বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাধারণত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে। প্রোডাক্টগুলোর প্রাইস, কোয়ালিটি বিষয়গুলো অ্যাসোসিয়েশন দেখে এবং সার্টিফিকেশন দেয়। আমরাও যাতে একইভাবে অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের এই সার্টিফিকেশন দিতে পারি সে ব্যবস্থা করার জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করবো। এর ফলে কিন্তু সরকারও লাভবান হবে। তখন কোনো প্রাইস ভেরিয়েশন হবে না। অন্যভাবে কেউ কোনো কপি প্রোডাক্ট আনতে পারবে না।


চতুর্থ, কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের প্রোডাক্ট সম্পর্কে সারাদেশের মানুষকে সচেতন করে তুলতে চাই। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরে যে সময়টা গ্যাপ থাকে ওই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বড় পরিসরে ভিএলএস ল্যাবে হার্ডওয়্যারের ওপর আমরা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পক্ষ থেকে সারাদেশে একটা সচেতনতামূলক ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করতে চাই। যেমন, অনেক স্কুলে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে। ৮০% কম্পিউটার অব্যবহৃতভাবেই পড়ে আছে। এগুলো পরিচালনা ও মেইনটিন্যান্স করতে না পারার কারণে সেগুলো আর ব্যবহার করা হয়ে উঠে না। আবার দেখে গেছে ইন্টারনেট আছে ক্যাবল কানেকশন, সাধারণ সার্ভার নলেজ, আইপি অ্যাড্রেস যোগ করা এসব ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম করতে চাই। আমরা চিন্তা করেছি চলতি বছরে সারাদেশের ৩ লাখ ছাত্রছাত্রীকে ফ্রি ট্রেনিং দেবো। এভাবে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে দেশের মানুষকে কম্পিউটার ও হার্ডওয়্যারের প্রোডাক্ট সম্পর্কে সচেতন করতে চাই। এটাতে সরকারে সহযোগিতা দরকার।



বিবার্তা : নতুন কমিটির সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কি কি?


সুব্রত সরকার : সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিজনেস ডেভেলপমেন্ট। এ মুহূর্তে আইটি বিজনেসটাকে যদি সঠিকভাবে ডেভেলপ করতে না পারি, সঠিক পথ না দেখাই বা পরিচালনা না করতে পারি তাহলে কিছুদিন পরে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে যাবে। আপনি হয়তো জানেন, আইটি সেক্টরে অনেক বড় বড় কম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। কেন হয়েছে? মার্কেটে অনএথিক্যাল কম্পিটিশনের কারণে। এর জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানিগুলো এক দিকে থেকে দায়ী। তারা আনএথিক্যাল কম্পিটিশনটা কেন পাঠায়? তাদের কাছে কোনো ডাটা নাই। বাংলাদেশে এক বছরে কতগুলো মনিটর লাগবে, কতগুলো ল্যাপটপ বাংলাদেশ এক বছরে চাবে। আপনি ‍খোজ নিয়ে দেখেন তো এ বিষয়ে কোনো ডাটা আছে নাকি তাদের কাছে? তারা নিজের থেকে মনগড়া ডাটা তৈরি করে বলে, আরে আমার তো এ বছর ৫ লাখ পিস ল্যাপটপ চলার কথা ছিল। আপনি তো ২ লাখ পিস চালাইছেন। কেন চালাইতে পারলেন না। সে তখন হুলুস্থূল লাগাইয়া দেয়। কারণ তার তো ডিস্ট্রিবিউশন ক্যান্সেল হয়ে যাবে। ডিস্ট্রিবিউশন ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ার আগেই সে আরেক লাখ ল্যাপটপ বুক করে অর্ডার দিয়ে ফেলে আগে টেন্ডারের জন্য। বাজার তখন ওভারল্যাপিং হচ্ছে শেষে তখন তাকে নির্দিষ্ট দামের কমে গিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আগে আমাদের বাজারটাকে স্থিতিশীল করতে হবে।


বিবার্তা : এই সেক্টরের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?


সুব্রত সরকার : আমাদের দেশে অনেক ভালো মানের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। অসংখ্য দক্ষ ও ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে রয়েছে। এরা মেধা ও দক্ষতার দিকে চীনের ছেলেমেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এদের শুধু আরো ভালো করে ট্রেনিং দিয়ে কম্পিউটার সার্ভিসিং শিক্ষায় শিক্ষিত করলে এরাই বিদেশে গিয়ে মিলিয়ন ডলার আয় করতে সক্ষম হবে।


বিবার্তা : চলতি মেয়াদের শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?


সুব্রত সরকার : আমি ১৯৯১ সালে থেকে এই ইন্ডাস্ট্রিজের সাথে জড়িত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ডাস্ট্রির নানান কর্মকাণ্ডের সাথেও যুক্ত ছিলাম। আমি এই ইন্ডাস্ট্রিকে ভালোবাসি। এর জন্য কাজ করতে পছন্দ করি। তাই এই দায়িত্ব নেয়ার পরে আরও কাজের পরিধি বেড়ে গেছে। নির্বাহী পরিষদের সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় এই ইন্ডাস্ট্রিকে একটা ভাল প্লাটফর্মে নিয়ে যেতে চাই।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com