এইডস নিয়ে যত ভুল ধারণা
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৪
এইডস নিয়ে যত ভুল ধারণা
হাবুবুর রহমান রোমেল
প্রিন্ট অ-অ+

এইচআইভি/এইডস এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে বিশ্ব সম্প্রদায় ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্ব এইডস দিবস পালন করে আসছে। এটি বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বিষয়ক সংকটগুলোর একটি। ১৯৮০ সাথে প্রথম এই ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করেছে বলে জানা যায়।


ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, সারা বিশ্বে এইচআইভি আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা চার কোটি ৫০ লাখ ৫৭ হাজার প্রায়। এইডস আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৫ জন। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ ২০২২ সালের তথ্যমতে, দেশে আনুমানিক এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩ জন।


নিরব এই ঘাতক নিয়ে সমাজে রয়েছে নানা কুসংস্কার ও ভুল ধারণা। চলুন জেনে নেই এইডস নিয়ে প্রচলিত যত অমূলক ধারণা-


# এইচআইভি পজিটিভ হলেই এইডস হবে?


আমাদের ধারণা এইচআইভি পজিটিভ হওয়া মানেই এইডস-এ আক্রান্ত হওয়া। মূল কথা হলো- এইচআইভি সংক্রমণ থেকে এইডস হয় ঠিকই, কিন্তু এর মানে এই নয় যে এইচআইভি পজিটিভ হলেই এইডস হবে।


# আক্রান্তদের সাথে সাধারণ মেলামেশা


সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট রোগকে সংক্রামক রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ বলে। তবে এইডস ছোঁয়াচে রোগ নয়। ২০১৬ সালেও যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করত এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে বা তার চামড়া ও মুখের লালা থেকে অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে, একই পাত্রে খাবার খেলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির জিনিসপত্র ব্যবহার করলে, তার ব্যবহৃত টয়লেট শেয়ার করলেও বাকিরা এইচআইভিতে আক্রান্ত হবেন না।


# এইচআইভি পজিটিভ হলে সুস্থ সন্তান জন্ম দান সম্ভব নয়


আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, এইচআইভি পজিটিভ হলে রোগহীন সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়া অসম্ভব। মা যদি এইচআইভি পজিটিভ হন, তখন এটি হতে পারে, তাও এর সম্ভাবনা খুব কম। ১০০ ভাগের এক ভাগও নয়, দশমিক পাঁচ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে। এই দশমিক পাঁচ শতাংশের মধ্যে পড়ে গেলে সন্তানও এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে।


# এইচআইভি পজিটিভ কোনো বড় সমস্যা নয়


অনেকেই মনে করেন আধুনিক চিকিৎসায় এইচআইভি পজিটিভ কোনো বড় সমস্যা নয়। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এই ভুল ধারণার ফলে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে এইচআইভি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ সারা দেশে যত রোগীর আছে তাদের মধ্যে ৯০ ভাগের রোগই ছড়িয়েছে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে।


# এইচআইভি পজিটিভ হলে কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই


অনেকেই ধারণা, যদি নারী-পুরুষ দুজনেই এইচআইভি পজিটিভ হয়- তাহলে তাদের সুরক্ষার প্রয়োজন নেই। মনে রাখাতে হবে, সব এইচআইভি ধরণ একই রকম নয়। একজন একসাথে একাধিক ধরনে আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। যাকে বলা হয় সুপার ইনফেকশন।


# এইচআইভি মশার দ্বারা ছড়াতে কি পারে?


মশা কামড়ে একজনের শরীর থেকে রক্ত খেয়ে সেই রক্ত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির শরীরে ইনজেকশন দেয়ার মতো করে রক্ত ঢুকিয়ে দিতে পারে না। আর মশা বা অন্য কিটের শরীরে এই জীবাণু খুব সামান্য সময় বেঁচে থাকে।


# এইচআইভি আক্রান্তের মুখ দেখে বোঝা যায়?


এখনও অনেকেই মনে করেন কেউ এইচআইভি পজেটিভ হলে তার মুখ দেখে বোঝা যাবে। অথচ আক্রান্তের সাধারণত কোনো লক্ষ্মণ থাকে না। তাই মুখ দেখে বোঝা যাওয়ার ধারণাটি ভুল।


# বিসমকামীদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই


সমীক্ষা বলছে সমকামীদের মধ্যেই এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। কারণ সারা বিশ্বে এইচআইভি আক্রান্তদের ৭৮ শতাংশ সমকামী। অন্যদিকে আক্রান্তদের ২৪ শতাংশ বিষমকামী। তাই শুধু সমকামীরাই আক্রান্ত হতে পারে এই ধারণা একেবারেই ভুল। অন্যদের ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য।


# পিআরইপি নিলে কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই


পিআরইপি নিলে আর কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই- অনেকেই এমনটা ভাবেন। কিন্তু প্রি-এক্সপোজার প্রফিলেক্সিস এক ধরনের মেডিকেশন যা এইচআইভি ইনফেকশন না ছড়াতে সাহায্য করে। তবে পিআরইপি, যৌন মিলনের সময় এইচআইভি সংক্রমণ রুখতে পারে এমন কোনো প্রমাণ এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই।


# এইচআইভি রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই


এইচআইভি রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই, অনেকেই এমনটা মনে করেন। কিন্তু এইচআইভিতে আক্রান্ত হলেই তা পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। অন্তত তিন মাস সময় লাগে ধরা পড়তে। তাই এইচআইভি নেগেটিভ মানেই কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই এই ধারণাটা সঠিক নয়।


# কোন লক্ষণ না থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত নন এটিও ভুল ধারণা।


কোনো লক্ষণ দেখা না দিলে এইচআইভি আক্রান্ত নন এটিও ভুল ধারণা। এই জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার পরও একজন ব্যক্তির শরীরে দীর্ঘ দিন কোন রকমের লক্ষণ দেখা নাও দিতে পারে। এভাবে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি দশ থেকে পনেরো বছরও বেঁচে থাকতে পারেন।


এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাব দেখা দিতে পারে, হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীরে র‍্যাশ দেখা দিতে পারে। অন্যান্য লক্ষণগুলো দেখা দেবে যখন ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করাই এইচআইভির মূল কাজ।


প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকলে কাশি, ডায়রিয়া, চামড়ার নিচে ফুলে যাওয়া গোটার মতো দেখা দেবে ও ওজন কমে যাবে। চিকিৎসার অভাবে আরও ভয়াবহ ঘটনাও ঘটতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে সামান্য অসুখেও মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয় যদি তার চিকিৎসা না নেয়া হয়। কারণ শরীর তার স্বাভাবিক নিয়মে আর অসুখের সাথে লড়াই করতে পারে না।


# ওরাল সেক্সে কি এইডস হতে পারে?


আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ওরাল সেক্স অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এইচআইভি পজিটিভ নারী বা পুরুষের সাথে ওরাল সেক্সের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়া সম্ভব। কিন্তু এর হার খুব বিরল।


# এইচআইভি আক্রান্তরা অল্প বয়সে মারা যায়?


ইদানিং নানা ধরনের চিকিৎসার জন্য এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিও দীর্ঘদিন সুস্থ জীবনযাপন করতে পারছেন। বর্তমানে এইচআইভি’র এমন চিকিৎসা রয়েছে যে তিনি এইডসে মারা যাবেন না। তাদের চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব তবে একেবারে নিরাময় করে ফেলা সম্ভব না। তাদের অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত লক্ষণহীন রাখা সম্ভব এবং আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে রাখা সম্ভব।


জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক সংস্থা বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের ক্ষেত্রে এইচআইভি জীবাণুর মাত্রা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে। এমনকি অনেক সময় রক্ত পরীক্ষায়ও জীবাণুটি ধরা পরে না। তবে তারা যদি চিকিৎসায় অবহেলা করেন তবে এর মাত্রা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।


# এইচআইভি পজিটিভ মানেই কি মৃত্যু?


আমাদের প্রায় সবারই ধারণা এইচআইভি পজিটিভ মানেই মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যু এড়ানো অনেকাংশেই সম্ভব বলেই মনে করছেন চিকিৎসকরা।


বিবার্তা/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com