চট্টগ্রামে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে মৃত্যু, অসহায় স্বাস্থ্য বিভাগ
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ২১:০৭
চট্টগ্রামে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে মৃত্যু, অসহায় স্বাস্থ্য বিভাগ
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চট্টগ্রামে মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। বিভিন্ন উপজেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছেই। ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে মৃত্যু। স্বাস্থ্য বিভাগের কোন ব্যবস্থাই কাজে আসছে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও অসহায়।


ভাইরাসজনিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে সাধারণত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু এ বছর নির্ধারিত সময়ের আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। চলতি বছরের মোট আক্রান্তের প্রায় ৪০ শতাংশই সেপ্টেম্বর মাসে শনাক্ত হয়েছে। যা উদ্বেগজনক- বলছেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোনও ব্যক্তিকে কামড়ালে চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যায়।


চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হওয়া ৭৪ জনের মধ্যে ২১ জনই মারা গেছেন সেপ্টেম্বর মাসে। যা মোট মৃত্যুর ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছর সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর সংখ্যা গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৭ গুণ বেশি। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে মারা যান মাত্র ৩ জন। অন্যদিকে, এ বছর আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ২৮ জন মারা গেছেন। যা মোট মৃত্যুর ৩৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জুলাই মাসে মারা যান ১৬ জন বা মোট মৃত্যুর ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ।


ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি শিশুর;


চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে শিশুরা কম আক্রান্ত হলেও মৃত্যু বেশি। মোট ৭৪ জনের মধ্যে ২৬ জন শিশু মারা গেছে। যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে নারীরা। এ বছর প্রায় ২৫ জন বা ৩৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারী মারা গেছে ডেঙ্গুতে। অন্যদিকে পুরুষ মারা গেছে ২৩ জন। যা শতাংশের হিসেবে ৩১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। শক সিনড্রোম, হেমোরেজিক সিনড্রোম ও এক্সপান্ডেট সিনড্রোম ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে জানান চিকিৎসকরা। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে কেউ মারা না গেলেও ২০২১ সালে ৫ জন এবং ২০২২ সালে মারা গেছেন ৪১ জন।


চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৬৭৯ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ গত তিন মাসে এর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বর মাসে ৩ হাজার ৮৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যা মোট রোগীর প্রায় ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ। আগস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী পাওয়া যায় ৩ হাজার ১১ জন। যা রোগীর প্রায় ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ। জুলাইয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ৩১১ জন ডেঙ্গু রোগী। যা এ বছর মোট আক্রান্তের ২৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ ছাড়া গত জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিল ২৮৩ জন। মে মাসে ৫৩ জন, এপ্রিল মাসে ১৮ জন, মার্চ মাসে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন এবং জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত পাওয়া যায় ৭৭ জন।


উপজেলার চেয়ে নগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি;


গত এক বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে উপজেলার চেয়ে নগরের রোগী বেশি। মোট ৯ হাজার ৬৭৯ জনের মধ্যে ৬ হাজার ৭৭৫ জনই নগরের বাসিন্দা এবং ২ হাজার ৯০৪ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। আবার উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী মিলেছে সীতাকুণ্ড, পটিয়া এবং হাটহাজারী উপজেলায়। সীতাকুণ্ডে ১ হাজার ২৪ জন, পটিয়ায় ৩১৫ জন এবং হাটহাজারীতে ২৩৭ জন। উল্লেখ্য, তিন উপজেলাই চট্টগ্রাম নগরের খুব কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত।


সেপ্টেম্বের চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের চেয়ে উত্তরের উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। উত্তরের সীতাকুণ্ড উপজেলা এই তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে। এখানে এখনও পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৯৬৭ জন। এছাড়া হাটহাজারীতে ২১৭ জন, মিরসরাইয়ে ১৬৬ জন, ফটিকছড়িতে ১৩৩ জন, রাউজানে ১০০ জন, রাঙ্গুনিয়ায় ৫৭ জন ও সন্দ্বীপে ৫৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। উত্তর চট্টগ্রামে মোট শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬৯৫ জন ডেঙ্গু রোগী। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ায় সর্বোচ্চ ২৯৬ জনের শরীরের ডেঙ্গু পাওয়া গেছে। তবে বাঁশখালীতে ১৭৬ জন, সাতকানিয়ায় ১২১ জন, আনোয়ারায় ১১৪ জন, লোহাগাড়ায় ৯২ জন, কর্ণফুলীতে ৭৪ জন, বোয়ালখালীতে ৬৫ জন ও চন্দনাইশে ৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সেই হিসেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯৪ জন।


বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, সীতাকুণ্ডে রোগী বেশি শনাক্ত হওয়ার কারণ উপজেলাটির সীমানা। এই উপজেলার বেশকিছু অংশ নগরের মধ্যে। তাই এসব এলাকার মানুষ হাসপাতালে ভর্তির তথ্যে ঠিকানা সীতাকুণ্ড উল্লেখ করছে। তাই নগর-গ্রাম মিলে সীতাকুণ্ডে আক্রান্তের সংখ্যাটা বেশি।


চট্টগ্রামের জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছ বলেন, ‘শহরের আশপাশের উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সেই হিসেবে সীতাকুণ্ড ও পটিয়া উপজেলাতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। আর সীতাকুণ্ডে ভারী শিল্পাঞ্চল ও জাহাজ ভাঙা শিল্প রয়েছে। এসব ভাঙারি জিনিসে পানি জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে। ফলে এডিস মশা বংশ বিস্তারের সুযোগ পায়। এছাড়া এখানকার জেলেপাড়াগুলোতে পানির সংকট রয়েছে। তাই তারা পানি ধরে রাখে। এই ধরনের জমিয়ে রাখা পানিতে সহজেই বংশ বিস্তার করতে পারে এডিস মশা। ফলে উপজেলায় বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী।’


এদিকে চলতি বছরের গত ৯ মাসের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আগামী দিনগুলোতে এর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, ভরা বর্ষায় সাধারণত এ রোগের প্রকোপ থাকে না। বর্ষা শেষ হওয়ার পরপরই এর প্রকোপ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, জুলাই থেকে পরের মাসগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। যদিও এ বছর খুব তাড়াতাড়িই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে। এ প্রকোপ অব্যাহত থাকলে এ বছরের পরের মাসগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।


সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটকূশলী মো. মাঈনউদ্দিন বলেন, বাড়ির আশপাশে পরিষ্কার রাখা আমাদের দায়িত্ব। কোথাও পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। জরিপে দেখা গেছে, নগরের আকবর শাহ, ষোলশহর, পাঁচলাইশ এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব এলাকায় এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। তবে চট্টগ্রামের অন্য এলাকায় এডিস মশা পাওয়া যাবে না বা ডেঙ্গু রোগ ছড়াবে না তা কিন্তু নয়। একটি মশা এক কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। সুতরাং মানুষকে সচেতন হতে হবে।


বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এর মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রশীদ বলেন, জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জ্বর হলেই প্রথম দিনেই এনএস ওয়ান পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়লে পর্যাপ্ত পানি জাতীয় খাবার এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকবেন। এসময়ে অ্যাসপিরিন জাতীয় ও ব্যথার ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। বমি, পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে কোথাও রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট অথবা রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই উত্তম। সেজন্য মশারি ব্যবহার, বাচ্চাদের ফুল হাতা জামা পড়ানো, বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সাধারণ জনগণের সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দিলে অতি দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী।


বিবার্তা/জাহেদ/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com