ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন: ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ২১:২৯
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন: ড. কবিরুল বাশার
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছর এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক বেড়েছে। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই ভয়ংকর হচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গত জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০৪ জনের। চলতি আগস্ট মাস এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫৩ জনে। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ভয়াবহ আকারে ছড়ানোর কারণ কী, এডিস মশা ও ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং এ নিয়ে জনগণের করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী ড. কবিরুল বাশার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবার্তার প্রতিবেদক এস এম রিয়াদ রহমান।


বিবার্তা: বাংলাদেশে এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু বাড়তে শুরু করে ২০০০ সালে। ওই বছরই ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৯৩ জন। এরপর ২০১৯ সালে ১৬৪ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ বছর ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৪৫৩ জন। এগুলোকে কী আমরা মৃত্যু বলব, না হত্যা?


ড. কবিরুল বাশার: ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতা আমাদেরকে সত্যি ব্যথিত করে। কোনো মৃত্যুই আমাদের কাছে কাম্য নয়। যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বটুকু পালন করলে এ মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। বিশেষ করে মৃত্যু হয় রোগী বেশি দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। আমি সকলকে অনুরোধ করব ডেঙ্গু বা এই মুহূর্তে যেকোনো জ্বর হোক না কেন, সেটি সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করিয়ে নিবেন। যদি আপনার ডেঙ্গু হয় তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে থাকবেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো থাকলে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম থাকে।


বিবার্তা: ২০২০ ও ২০২১ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তেমন দেখা যায়নি, এর কী কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে?


ড. কবিরুল বাশার: ২০২০ এবং ২০২১ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তেমন দেখা যায়নি, এমন নয়। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালে ডেঙ্গু কিছুটা কম হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে ৬২ হাজারের উপরে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল ২০২২ সালে, ২৮১ জন।


বিবার্তা: এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ কী?


ড. কবিরুল বাশার: এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ আছে। তার মধ্য অন্যতম কারণ হচ্ছে—২০২২ সালে ডেঙ্গুর মৌসুম বিলম্বিত হওয়া। ২০২২ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডেঙ্গুর পিক মৌসুম বা সর্বোচ্চ ডেঙ্গু হয় অক্টোবর মাসে। এর আগে কোনো বছর এ রকম ঘটনা ঘটেনি। ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর পিক মৌসুম ছিল আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২০২২ সালে সেটি শুধু হয়েছিল অক্টোবরে এবং সেটি বর্ধিত হয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর, জানুয়ারি পর্যন্ত এসেছিল। যখন এ বছরে এডিস মশা প্রজনন করেছে এবং ডেঙ্গু বৃদ্ধি পেয়েছে সেই ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলের পরে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশা প্রজননের হার জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। এজন্য ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এত বেশি। এছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তনও আমরা কারণ হিসেবে দেখে থাকি।


বিবার্তা: এ বছর মশার ধরন বা ভ্যারিয়েন্টে কোনো ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে কী?


ড. কবিরুল বাশার: এডিস মশা দুটি প্রজাতি আছে। একটি এডিস এজিপটি, যাকে আমরা নগরের মশা বা শহরের মশা বা গৃহপালিত মশা বলে থাকি। অন্যটি হলো এডিস এলবোপিকটাস যাকে গ্রামের মশা বলা হয়। তবে এখন এডিস মশার আচরণগত পরিবর্তন হয়েছে। আমরা জানতাম এডিস মশা শুধু পরিষ্কার পানিতে হয়, কিন্তু এখন দেখছি এডিস মশা নোংরা পানিতেও হয়। আবার আমরা জানতাম যে এডিস মশা শুধু দিনে কামড়ায়। কিন্তু এডিস মশা এখন দিনে ও রাতে যেকোনো সময় কামড়ায়, সেটি আমরা পরীক্ষাগারে ও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করে প্রমাণ পেয়েছি।


বিবার্তা: এডিস মশা নিধনে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তবু কেন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি?


ড. কবিরুল বাশার: নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আসলে এডিস মশা নিধনে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করতে হবে। মানুষের বাসা-বাড়ি, বাসা-বাড়ির আঙিনায় যেহেতু এডিস মশা হয়, সেহেতু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মানুষের বাসা-বাড়ি টার্গেট করে পরিষ্কার করতে হবে। এবং এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।


বিবার্তা: শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব জেলায় ডেঙ্গুর উপদ্রব ছড়িয়ে পড়ছে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?


ড. কবিরুল বাশার: এখন বাংলাদেশের সকল জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে আগস্টের শেষের ও সেপ্টেম্বর মাসে। এবং দেশের সব জেলাতেই এর প্রকোপ আরও বাড়বে। সেজন্য প্রত্যেকটি জেলা শহরেই যেখানে পৌরসভা আছে, সিটি করপোরেশন আছে অথবা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম ও সচেতনতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।


বিবার্তা: এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুদের সংখ্যা মোট আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশ। শিশুরা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবেলার উপায় কী?


ড. কবিরুল বাশার: এ বছর শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর অনেকগুলো কারণ আছে—শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করার কারণে শিশুদের শরীরে ঘাম হয়, শরীরের তাপমাত্রা নির্গত হয়, শরীরে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়, এসব কারণে মশা তার দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়। শিশুরা রঙিন জামা-কাপড় পরে, সেটিও একটি কারণ। শিশুদের ত্বক নরম এটিও একটি কারণ। এসব নানা কারণে শিশুরা মশার দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হয়।


বিবার্তা: মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকে কীভাবে দেখছেন? ডেঙ্গু নিয়ে সর্বশেষ কোনো গবেষণা হয়েছে কি না?


ড. কবিরুল বাশার: মশাবাহিত রোগ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তাই এটি মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। যে প্রতিষ্ঠানটি বাহক বাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করবে এবং বাহক বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক, যন্ত্রপাতি এসব নিয়ে গবেষণা করবে। এটি রাষ্ট্রের একটি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিবে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন যন্ত্রাংশ দিয়ে কীটনাশকের মাধ্যমে কোন মশা কোন বাহককে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।


বিবার্তা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জনসংখ্যার আধিক্য অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। এ বিষয়ে আপনার কী মন্তব্য?


ড. কবিরুল বাশার: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জনসংখ্যার আধিক্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন—এসব মিলেই সারা পৃথিবীতে ডেঙ্গু বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে আছে।


বিবার্তা: ডেঙ্গু এখন সারা বছর হলেও দুই সিটি করপোরেশনকে শুধু বর্ষা মৌসুমে তৎপর হতে দেখা যায়, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই?


ড. কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু এখন সারা বছরই হবে—এটি আমি দুবছর আগেই বলেছি। বিবার্তার একটি সাক্ষাৎকারে সেটি ছাপা হয়েছে। সেজন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের সারা বছরব্যাপী মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সেটির বাস্তবায়ন করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা শুধু সিজনমাফিক করলে হবে না।



বিবার্তা: বর্তমানে ডেঙ্গুর যা প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, আগস্টের শেষে ও সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি কি হতে পারে বলে মনে করেন?


ড. কবিরুল বাশার: এ মাসের শেষে ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব বেশি উন্নতি হবে বলে আমাদের ফরকাসটিং মডেল অনুযায়ী আমরা দেখছি না। এখন যে অবস্থা চলছে আগস্টের শেষে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আমার মনে হয়।


বিবার্তা: দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে দেশে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মহামারি আকার ধারণ করে। আমরা প্রতিবছর আপদকালীন সময়ে ডেঙ্গু নিধনে নানা পদক্ষেপ দেখি। কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নাই কেন?


ড. কবিরুল বাশার: বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ইতিপূর্বে আমরা দেখলেও এখন ডেঙ্গুর মৌসুম সারা বছরই শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় বিদ্যমান। ঢাকা শহরে গাড়ি রাখার স্থানে, নির্মাণাধীন ভবনে, জমিয়ে রাখা ড্রামে, বালতির পানিতে এডিস মশা পাচ্ছি। এডিস মশা পাচ্ছি ওয়াসার মিটার কলে, যেটিতে সারা বছর পানি বিদ্যমান। এসব পাত্রগুলোতে সারা বছর এডিস মশার প্রজনন বিদ্যমান থাকে। এডিস মশা এখন সারা বছরের সমস্যা। ডেঙ্গু আমাদের সারা বছরের সমস্যা।



বিবার্তা: ডেঙ্গু নিধনে আপনার পরামর্শ জানতে চাই?


ড. কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু নিধনে আমার পরামর্শ হলো—এডিস নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যে পরিকল্পনাটি হবে ১০ বছর মেয়াদি। এ পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে হবে প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা এবং প্রত্যেক বাড়ির মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা। এ কাজটি প্রতি সপ্তাহে করতে হবে প্রতিটি বাসায়। তার সাথে একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিতে হবে ৫০০ বা ১০০০ বাড়ির জন্য। প্রতিটি বাড়ির সব জায়গা স্বাস্থ্যকর্মী ঘুরে দেখবে। কোথাও এডিস মশার প্রজনন দেখলে সে বাড়ির মালিককে দিয়ে সেটি পরিষ্কার করাবে। একবার মশা পাওয়া গেলে তাকে হলুদ কার্ড দেওয়া হবে, দুবার পাওয়া গেরে আবার হলুদ কার্ড দেওয়া হবে, তৃতীয়বার পাওয়া গেলে লাল কার্ড এবং জরিমানা করা হবে। এ রকমভাবে প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে ধরে যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমটি যদি পরিচালনা করতে পারি টানা ১০ বছর ধরে, তখন একটা সময় বাংলাদেশে এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে।


বিবার্তা: আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।


ড. কবিরুল বাশার: আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com