জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে নিজস্ব সমাজ দর্শন ও দক্ষতার সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ২৩:২১
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে নিজস্ব সমাজ দর্শন ও দক্ষতার সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

গতানুগতিক ধারা পরিবর্তন করে দক্ষতাভিত্তিক, কর্মমুখি এবং বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে মিল রেখে দ্রুত কর্মসংস্থানমুখী কারিকুলাম প্রণয়নের লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি গবেষকদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) দুইদিনব্যাপী এই কর্মশালা শুরু হয়েছে।


কর্মশালার প্রথম দিনের উদ্বোধনী সেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান।


বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. পবিত্র সরকার। কর্মশালায় বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম প্রণয়নে নিজস্ব সমাজ দর্শন ও দক্ষতাভিত্তিক কোর্সের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।


কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, শিক্ষার্থীরা যেন সেই দক্ষতা ও শিক্ষা নিয়ে বের হতে পারেন, যা কর্মজগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে এবং শিক্ষার্থীরা যখন কর্মজগতে প্রবেশ করতে যান, তখন যেন সেই প্রবেশটি সহজ হয়। এছাড়া কর্মজগতের চাহিদার সঙ্গে যেন তাঁরা খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, সেই জন্যই এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।


শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আরো বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স-কারিকুলাম উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জায়গাটার সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ধরনের কোর্স প্রবর্তনের উদ্যোগ এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছে। তারা কর্মমুখি পিজিড কোর্স, শর্ট কোর্স চালু করেছে।


শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আরো বলেন, আমাদের উপর উপনিবেশিক যে শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটি ছিল একেবারে মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর। সেখান থেকে বেরিয়ে হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণটা আমাদের দরকার ছিল। সেকারণেই প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজের সম্পর্কে, পরিবেশ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাবে। বাস্তবমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। তারা অনেক বেশি দায়িত্বশীল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও সেই বিষয়টি চলে আসবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের ভাষা, আইসিটি, সফটস্কিল শেখা ভীষণভাবে জরুরি। অন্ট্রাপ্রেনারশিপে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবে। এভাবে দক্ষতাভিত্তিক বিষয়গুলোকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।


শিক্ষার মানোন্নয়নে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আশা করি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম পরিমার্জনের এই উদ্যোগ সফল হবে। তাদের বিশাল শিক্ষা পরিবারের মান ক্রমে বৃদ্ধি পাক এই প্রত্যাশা রইল।


সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম আধুনিক হওয়া উচিত, পরীক্ষা পদ্ধতি আধুনিক হওয়া উচিত, আমাদের খাতা দেখা ও মূল্যায়নের জায়গাটাতে পরিবর্তন দরকার, প্রশ্ন প্রণয়নে পরিবর্তন আনা দরকার- এসব বিষয়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে। সেকারণে প্রতিটি বিষয়ে আমরা মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। সমাধানের পথে এগোচ্ছি। সর্বাগ্রে আমরা একইসঙ্গে দুটো কাজে হাত দিয়েছি; সেটি হলো- একটি আধুনিক কারিকুলাম প্রণয়ন এবং পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মশালা আয়োজন করে এসব কার্যক্রম উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা হয়তো আগামীকালকেই সকল সমস্যা সমাধান করতে পারব না। তবে আগামী ২ বছরের পরিকল্পনায় এলএমএস ও কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট করে আপনাদের প্রত্যেকের লেকচার আমার শিক্ষার্থীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারবো।


আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি বিশেষজ্ঞবৃন্দের বক্তব্য শুনতে পারে তাহলে তাদের অন্তর দর্শন খুলে যাবে। দক্ষিণ এশিয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেটি আমাদের জন্য বিশাল সুযোগ। যতো বাধা-বিঘ্ন আসুক না কেন- আগামী ৩ বছরের পরিকল্পনায় জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা সকল বাধার উত্তরণ ঘটাব। আমি শিক্ষা প্রশাসনের সকলকে অনুরোধ করব- এটি একটি শুভযাত্রা, নান্দনিক যাত্রা। আসুন একসঙ্গে বসে জ্ঞান চর্চায়, মুক্তবুদ্ধি চর্চায় এই প্রাঙ্গনকে আরো অবারিত করি, সুন্দর করি। এটিকে আরো বেশি পরিশালিত করি।


দেশের প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী ড. মশিউর রহমান বলেন, কারিকুলাম উন্নয়নে ৩২টি ডিসিপ্লিনে ঢাকার বাইরে প্রত্যেকটি ডিসিপ্লিনে আলাদা আলাদা কর্মশালা আয়োজন করেছি। আমাদের বিদ্যমান যে কারিকুলামটি রয়েছে সেটিকে শিক্ষার্থী উপযোগী, বাংলাদেশ উপযোগী, পরিবর্তিত বিশ্বে কোভিডোত্তর পৃথিবীতে মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তোলবার জন্য করণীয় কী সেটিই আমাদের ভাবনার বিষয়। আশা করছি, আলোচনার মধ্য দিয়ে আধুনিক, যুগোপযোগী, শিক্ষার্থীবান্ধব কারিকুলাম তৈরি করতে পারবো।


উপাচার্য ড. মশিউর রহমান আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা, যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। হাজার বছরের বঞ্চিত মানুষের জন্য লড়াই করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল হয়েছেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক অগ্রসর দেশকে ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের স্বপ্নকে। আর বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশে ফিরে আসার পর শিক্ষাকে আধুনিক করা থেকে শুরু করে একটি অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক এবং অগ্রসর বাংলাদেশ তৈরিতে নিবিষ্টভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি অগ্রসরমান সমাজ প্রতিষ্ঠাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষার উৎকর্ষতা নিশ্চিত করা এটি একটি শ্রেষ্ঠ সময়। সবাই মিলে দক্ষিণ এশিয়ার ভয়েস প্রতিষ্ঠা করব। আর সবকছিুতে মার্কিন নীতি বা পাশ্চাত্যের ইমোশন আমাদের উপজীব্য, সেই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।


বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ভারতের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেছেন, ভাষাজ্ঞানের জায়গাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই পোক্ত হওয়া উচিত। একটি, দুটি, তিনটি-যে কয়টা ভাষাই হোক, সেটি ছেলেমেয়েদের একেবারেই পোক্ত করে দেয়া দরকার। আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের যাঁরা বিদেশে অসম্ভব সম্মান লাভ করেছেন-বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, তাঁরা সব গবেষণা করেছেন বিদেশি ভাষায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখেননি। এটি একটি সমস্যা।


ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার আরো বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর অন্তর পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু সব সময় সেটি সম্ভব হয় না। যখন পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের জন্য বসা হয়, তখন এটি ওপর থেকে নিচে যাবে, নাকি নিচে থেকে ওপরে আসবে- এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু দুটি মিলিত হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আর কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে, সেই ঐতিহাসিক কথাটিও সব সময় মাথায় রাখতে হবে।


দুইদিনব্যাপী এ কর্মশালায় ৩৭টি বিষয়ে দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও গবেষকগণ তাদের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন এবং মূল্যবান মতামত প্রদান করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকপূর্ব শিক্ষা বিষয়ক স্কুলের ডিন প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দিনের সঞ্চালনায় কর্মশালায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান।


রিসোর্স পার্সন হিসেবে কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. শরীফ এনামুল কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির, অ্যাকাউন্টিং বিভাগের অধ্যাপক ধীমান কুমার চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুর রশীদসহ ভারত ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষকগণ।


বিদেশি গবেষক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে রয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী সাবেক উপাচার্য রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রফেসর পবিত্র সরকার, কলকাতার নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মনিমালা দাস, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য প্রফেসর অশোক রঞ্জন ঠাকুর, কলকাতার পোর্ট ট্রাস্টের সাবেক সচিব সত্যব্রত দাস, কলকাতার জেআইএস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান সৌবিক চ্যাটার্জি, জেআইএস বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রধান ড. ধর্মপাল সিং, বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের আহ্বায়ক সৌম্যব্রত দাস, বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের সমন্বয়ক অর্পিতা কাঞ্জিলাল, ডা. দুলাল বসু, ডা. শিবাজী বসু, সর্দার সিমারপ্রীত সিং, ড. জয়দেব ভট্টাচার্য প্রমুখ।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com