
নিজ সন্তানকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া আর অশোভন আচরণের স্বীকার হয়ে জেদ করে মা রিকতা আকতার বানু গড়ে তোলেন প্রতিবন্ধী স্কুল। আর সেই স্কুলই এখন দারিদ্রপীড়িত চিলমারীতে আলো ছড়াচ্ছে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পার ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে রিকতা আকতার বানু প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রিকতা আকতার বানু লুৎফা সরকারি হাসপাতালের সেবিকা। মানব সেবাই তাঁর পেশা ও নেশা। কোনদিন কোন রোগীকে অবহেলা করেননি। অথচ নিজের প্রতিবন্ধী কন্যাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাড়িয়ে দেন ক্লাস থেকে। এরপর অনুভব করেন, যাদের সন্তান শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী- সেই অভিভাবকদের বুকে জমে আছে কত বেদনা! তাই গভীর মনবেদনা নিয়ে কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে রিকতা আখতার বানু ব্রহ্মপুত্র পারে নিজের জমিতেই গড়ে তোলেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ২০০৯ সালে ২৬ শতক জমিতে নিজেদের অথার্য়নেই দোচালা একটি টিনের ঘরে ৪ জন শিক্ষক এবং ৬৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় রিকতা আকতার বানুর স্বপ্নের স্কুলের। তারপর অনেক প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে তার এই ছোট্ট উদ্যোগটি এখন ধীরে ধীরে ব্যাপ্তি পাচ্ছে। আলো ছড়াচ্ছে চিলমারী উপজেলায়।
অভিভাবক মেনেকা বেগম বিবার্তাকে বলেন, আমার মেয়ের নাম সাদিয়া সুলতানা। বয়স প্রায় ৯ বছর। অন্য স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করাতে গেছিলাম- ভর্তি নেয় নাই। পরে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে এখানে ভর্তি করাইছি। স্কুলের গাড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে বাচ্চাকে নিয়ে আসে। আবার স্কুল শেষ হলে গাড়িতেই আবার বাড়িতে দিয়ে যায়। স্কুলের সময়টা আমি দুঃশ্চিতা মুক্ত থাকি। এই স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে পেরে আমার অনেক উপকার হয়েছে।
অভিভাবক লাভলী বেগম বিবার্তাকে বলেন, আমার সন্তান এই স্কুলে পড়ে। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারে নাই। খুব একটা দুঃশ্চিতায় ছিলাম। এখানে ভর্তি করার পর সে এখন কথা বলে। আগে আমি নিজেই তাকে স্কুলে নিয়ে আসতাম। এখন আর নিয়ে আসাও লাগে না। সে এখন একা একায় স্কুলে আসে।
স্থানীয়রা জানান, এই বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানরা আসতে পারলে অনেক খুশি হয়। বাড়িতে রাখার চেয়ে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসায় তাদের মানসিক উন্নয়ন হচ্ছে। অনেক শিশু এখান থেকে স্বাভাবিক পর্যন্ত হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স রিকতা আখতার বানু লুৎফা বিবার্তাকে বলেন, এই বিদ্যালটির কেন প্রতিষ্ঠা করলাম- তার পিছনে অনেক কষ্ট আছে। আমার মেয়েকে যখন জেনারেল স্কুলে দিয়েছি, তারা আমার মেয়েকে বাইর করে দিছে। প্রতিবন্ধী বলে তাকে গালিগালাজও করেছে। তারা তাকে পাগল-পাগলি বলত। তারপর আর তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারি নাই। সেই থেকে বুকের ভিতর অনেক যন্ত্রণা হতো।
তিনি আরও বলেন, সেই যন্ত্রণা থেকে আজ আমার এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে স্কুলের বিভিন্ন রকমের সমস্যা আছে। সরকার যদি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার আওতায় নিয়ে আসতো, তাহলে অনেক ভালো হতো। যে মেয়ের উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠান করেছি- সে এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ। ও স্কুলে আসলে স্কুল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাসায় যাবে না। আর সে এতো পরিমাণে আনন্দে থাকে তা দেখে আমার মন ভরে যায়।
একট কথা কি জানেন, প্রতিবন্ধী সন্তানকে সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পড়াতে না চাওয়া ও অপমানের কষ্ট মা-বাবা ছাড়া অন্য আর কারো পক্ষে বুঝতে পারার কথা নয়।
রিকতা আকতার বানু প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিন শাহ বিবার্তাকে বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যালয়টি ২০২০ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বিদ্যালয়ে প্রায় ৩ শতাধিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৪৩ জন শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছে। এরমধ্যে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়েছেন। বাকি শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত, সরকারি-বেসরকারি ভাবে সহায়তা করে বিদ্যালয়টি প্রসারিত করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাসামগ্রী ও খেলনা বৃদ্ধি করা গেলে আরও মান সম্মত পাঠদান সম্ভব।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ বিবার্তাকে জানান, দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোতে নিয়ে আসার বিশেষ উদ্যোগ সরকারের আছে। এর প্রেক্ষিতে সকল বিশেষায়িত বিদ্যালয় ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলায় যে সকল বিশেষায়িত বিদ্যালয় আছে- বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা যেখানে পড়াশোনা করছে সেখানে নজর দেয়ার জন্য সরকারের নির্দেশনা আছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিলমারীতে রিকতা আখতার বানু লুৎফা প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি।
ইতোমধ্যে স্কুলটি সরকারি সহায়তায় এসেছে। এ স্কুলটিতে যেন আরও বেশি সহযোগিতা করা যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে সবধরনের সহযোগিতা আমাদের থাকবে। তাছাড়াও জেলার সকল বিশেষায়িত বিদ্যালয় যেন সঠিক সহযোগিতা পায় ও তারা যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সবধরনের সহযোগিতা থাকবে।
বিবার্তা/রোমেল/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]