
পানির অপর নাম জীবন। আমাদের দেহের সিংহ ভাগ গঠন করেছে পানি। আর প্রাত্যহিক জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদানও পানি। তবে সেই পানি হতে হবে বিশুদ্ধ। তা যদি হয় দূষিত, তবে তা নানা বিপত্তি সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকা মহানগরীর কথা যদি ধরি, এর প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার পানির জন্য সর্বাংশে ঢাকা ওয়াসার ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানি সংগ্রহের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। পাত কুয়া আর চাপকল তো কবেই উঠে গেছে। ঢাকার চারপাশের নদীর পানি খুবই দূষিত। এ পানি পানের অযোগ্য তো বটেই; এমনকি সাধারণ ব্যবহারেরও অযোগ্য ।
ফলে মেগাসিটি ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর পানি সরবরাহের পুরো দায়িত্বটুকু পালন করছে ঢাকা ওয়াসা। মাঝে-মাঝে সরবরাহকৃত পানির মান ও বিশুদ্ধতা নিয়ে নাগরিকদের মাঝে কিছুটা অসন্তোষ বিরাজ করে। অনেকে বলে থাকেন পানিতে গন্ধ- এতে পোকা, ময়লা ইত্যাদি পাওয়া যায়। অনেক সময় পানি হয় ঘোলা।
কেন এটি ঘটছে আর এর কি কোনো সহজ প্রতিকার নেই?
ঢাকা ওয়াসা দুই ধরনের উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে, প্রয়োজনীয় পরিশোধন শেষে গ্রাহককে সরবরাহ করে থাকে। শতকরা প্রায় ৭৮ ভাগ পানির উৎস ভূগর্ভ। বাকিটুকু বুড়িগংগা ও শীতলক্ষার পানি পরিশোধন করে সরবরাহ করা হয়। ঢাকা ওয়াসা যে পানি এর সঞ্চালন ও বিতরণ নেট ওয়ার্কে সরবরাহ করে তা বিশুদ্ধ। এ পানি ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া পাবলিক হেলথ, আইসিডিডিআরবি বা অন্যান্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃকও মাঝে মাঝে মান পরীক্ষা করা হয়।
গ্রাহক ময়লা পানি কেন পায়?
মোট চারটি পয়েন্টে পানির দূষণ ঘটে
ক. গ্রাহকের গ্রাউন্ড রিজার্ভারে
খ. গ্রাহকের ওভারহেড ট্যাংকে
গ. গ্রাহকের সার্ভিস লাইনে
ঘ. ওয়াসার মেইন লাইনে
এটি কেন হয় এবং গ্রাহক পর্যায়ে করণীয়
তিনমাস অন্তর ওভারহেড ট্যাংক ও গ্রাউন্ড রিজার্ভার পরিষ্কার করা প্রয়োজন। অনেক সময় গ্রাহক তা যথা সময়ে করে না। ফলে ব্যবহারের পয়েন্টে অর্থাৎ ঘরের ট্যাপে, শাওয়ারে ময়লা পানি পাওয়া যায়। তাই গ্রাহককে অবশ্যই ভালো পানি পাওয়ার জন্য জলাধারসমূহ নিয়মিত যথাযথভাবে পরিষ্কার করতে হবে ।
গ্রাহকের সার্ভিস লাইন নির্মাণে মানসম্মত মালামাল অর্থাৎ পাইপ ও ফিটিংস ব্যবহার না করা হলে এবং অভিজ্ঞ মিস্ত্রি দ্বারা ওয়াসার মূল পাইপে সংযোগের কাজ না করালে এতে লিক থেকে যেতে পারে। আর এসব পয়েন্টে বা কাছাকাছি যদি পয়ঃলাইন বা কোনো ড্রেন লাইন থাকে, তবে এর মাধ্যমে পানি দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওয়াসার পানির লাইনে যদি পানির চাপ কম থাকে অর্থাৎ ভেতরে ফাঁকা থাকে সেই সময় পয়ঃলাইন/ড্রেনের ময়লা পানি পানির মেইন লাইন/সার্ভিস লাইনে প্রবেশ করে। পরে পানির চাপ ও প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে পাইপে প্রবিষ্ট ময়লা পানি ভালো পানির সাথে মিশে গ্রাহকের রিজার্ভারে ঢুকে পড়ে।
অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকাসমূহে যেখানে রাস্তাগুলো বেশ সরু এবং এ সরু রাস্তায় পানি, পয়ঃ, ড্রেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন ইত্যাদি লাইন বিদ্যমান থাকে।
উল্লেখ্য, ওয়াসার মেইন লাইনে পানি দূষণের ঘটনা এসব এলাকায়ই বেশি ঘটে থাকে। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা যেমন গুলশান, ধানমন্ডি ইত্যাদি এলাকায় ওয়াসার মেইন লাইনে দূষণ প্রায় ঘটে না বললেই চলে। কারণ এসব এলাকার রাস্তাগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত হওয়ার ফলে বিভিন্ন ভূগর্ভস্থ ইউটিলিটি লাইন স্থাপনের জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু যেসব এলাকার রাস্তা সরু, তাতে পানি ও অন্যান্য ছোট ব্যসের ইউটিলিটি লাইনগুলোকে বৃহৎ ব্যাসের পয়ঃ/ড্রেন লাইনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এসব পয়েন্টে যদি মেইন পাইপে কোনো জয়েন্ট থাকে বা এখান থেকে কোনো গ্রাহক সার্ভিস সংযোগ গ্রহণ করে থাকে তবে এর থেকে দূষণের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। গ্রাহককে তাই অবশ্যই খানিক দূর থেকে সংযোগ নিতে হলেও পয়ঃ ম্যানহোল বা ড্রেনের পিটের ভেতর থেকে কোনো মতেই সংযোগ নেয়া উচিৎ নয়। এতে দূষিত পানি পাওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
নিম্ন মানের কয়েল পাইপ দিয়ে কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ করে বস্তি এলাকায় গ্রাহক বেশ দূর থেকে পানির সংযোগ নিয়ে থাকে। এসব কয়েল পাইপ ড্রেন-নর্দমা, ময়লা ডোবা ইত্যাদির ভেতর দিয়ে গিয়ে থাকে। এসব পাইপে অবশ্যই লিক থাকে যার মাধ্যমে পানির অপচয় ও ময়লা পানি ওয়াসার সিস্টেমে ঢুকে থাকে। আবার কিছু গ্রাহক অবৈধভাবে অদক্ষ বাইরের লোকের সাহায্যে পানির সংযোগ গ্রহণ বা পুনর্বাসনের কাজ করে থাকে। এসব লাইনে প্রায়ই ত্রুটি থেকে যায়। যা অতি দ্রুত পাইপের পানি দূষণের কারণ হয়ে থাকে।
গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি সরবরাহ ও চাহিদার মাঝে খানিকটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের লোডশেডিং বৃদ্ধি, পানির স্তর নেমে যাওয়া ও অতিরিক্ত গরমের জন্য পানির চাহিদা বৃদ্ধি ঘটে। ফলে এ সময় পানির সুষম বণ্টনে সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় কোনো কোনো গ্রাহক সমস্যা সমাধানের জন্য অদক্ষ লোকের পরামর্শে নিজের সার্ভিস লাইনকে অবৈধভাবে ওয়াসার মেইন পানির লাইনে এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে স্থানান্তর, পাইপের উপর থেকে নিচে স্থানান্তর ইত্যাদি করে থাকে। এসব অবৈধ কাজ রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে সম্পন্ন করা হয় বিধায় এতে ত্রুটি থেকেই যায়। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো পানি দূষণ।
পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউটিলিটি সেবার ক্ষেত্রে নিজ নাগরিক দায়িত্বটুকু পালন জরুরি। উপযুক্ত দক্ষ লোক দ্বারা যথাযথ মান সম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে সার্ভিস সংযোগ গ্রহণ করা উচিৎ। নিজস্ব রিজার্ভারসমূহ সময় মতো পরিষ্কার করা দরকার।
নিজের সার্ভিস লাইনের প্রতি লক্ষ রাখা এবং যে কোনো পুনর্বাসন কাজ দক্ষ লোকের মাধ্যমে নিয়ম মেনে সম্পন্ন করা উচিৎ। এতে ময়লা পানি পাওয়ার সম্ভাবনা দূর হবে।
উল্লেখ্য, কোনো পয়েন্টে ময়লা পানি ঢুকলে তা শুধু একজনের বাড়িতে নয়; অনেক সময় একাধিক গ্রাহক বা সম্পূ্র্ণ এলাকায় ময়লা পানি ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ বিষয়ে গ্রাহকের সর্বোচ্চ সচেতনতা প্রয়োজন।
রাজধানীতে ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের টার্গেট নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এজন্য ওয়াসা ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে তিনটি বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে। মহানগরীর একজন মানুষও যেন নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। সায়েদাবাদ ফেস-৩, পদ্মা যশলদিয়া ও গান্ধবপুর পানি শোধনাগার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গান্ধবপুর বাদে বাকি দুটি প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। বৃহৎ তিনটি প্রকল্প থেকে ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ শুরু হলে মানুষ শতভাগ বিশুদ্ধ পানি পাবেন। তখন নগরবাসী সরাসরি কলের পানি পান করতে পারবেন। পানি আর কাউকে ফুটিয়ে খেতে হবে না। ইতোমধ্যে গোটা ঢাকা শহরে পানির নতুন পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকার অনেক এলাকায় প্লাস্টিকের নতুন পাইপ বসানো হয়েছে। বাকি এলাকাতে এ বছরের মধ্যে পাইপ স্থাপনের কাজ শেষ হবে।
ঢাকা দ্রুত সম্প্রসারণ ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পানির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির চাহিদা পূরণে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা কর্মসূচির আওতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে ঢাকা ওয়াসা।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার মোট উৎপাদিত পানির শতকরা ২২ ভাগ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকি ৭৮ ভাগ পানি ভূ-গর্ভস্থ উৎস তথা গভীর নলকূপের মাধ্যমে আসছে। ২০২১ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত পানির ৭০ ভাগ আসবে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে। অবশিষ্ট ৩০ ভাগ ভূ-গর্ভস্থ তথা গভীর নলকূপ থেকে আসছে।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার দৈনিক পানি উত্তোলন-উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৫৫ কোটি লিটার। আর দৈনিক গড়ে ২৪৫-২৫২ কোটি লিটার পানির চাহিদার পুরোটাই ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করছে। এর মধ্যে নতুন সংযোজন তেঁতুলঝোরা-ভাকুর্তা প্রকল্প। এখান থেকে বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে দৈনিক ১৫ কোটি লিটার পানি রাজধানীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ পানি মিরপুর এলাকায় সরবরাহ চলছে।
সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে গ্রাহকের ওভারহেড সাপ্লাই ট্যাংক ও আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভ ট্যাংক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিষ্কার রাখা অত্যাবশ্যক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে।
জেনে রাখা উচিত, গ্রাহকের মিটার পর্যন্ত নিরাপদ পানি সরবরাহের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার! তাই রিজার্ভ ট্যাংক থেকে সরবরাহ হওয়া পানির দায়ভার ঢাকা ওয়াসা গ্রহণ করে না।
পরীক্ষাগারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পানির ট্যাংক পরিষ্কার না করলে প্রাণঘাতী ভাইরাস ও জীবাণুদের জন্ম হয় রিজার্ভ ট্যাংক ও সাপ্লাই ট্যাংকে। যা ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার পরিণতি অনেক সময় ভয়াবহ হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
ঢাকা ওয়াসা ইতোমধ্যেই এ সমস্যা অনুধাবন করেছে এবং ওয়াসার সব অফিস ও আবাসিক ভবন পরিষ্কার রাখতে ‘ওয়াটার এইড লিমিটেডে’র সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
ওয়াটার এইড লিমিটেড দেশের প্রথম ও ঢাকা ওয়াসা অনুমোদিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা WHO গাইডলাইন অনুসরণ করে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পানির ট্যাংক পরিষ্কার সেবা দিয়ে থাকে।
আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পানির ট্যাংক পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখার মাধ্যমে অনেকাংশে পানিবাহিত রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
লেখক: আব্দুল ওয়াসেত,প্রকৌশলী,ঢাকা ওয়াসা।
বিবার্তা/রবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]