জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ২০:৪১
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’
নাটোর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

মধুসূদন পাল এখন আর পৃথিবীতে নেই। তবে তার রেখে যাওয়া অসাধারণ সৃষ্টি কাঁচাগোল্লা দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম কুড়িয়েছে অনেক আগেই।
অত্যন্ত সুস্বাদু কাঁচাগোল্লা সুনামের পাশাপাশি ঐতিহ্য বহন করছে যুগযুগ ধরে। শুধু তাই নয়, অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাত নাটোরের রানি ভবানীর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল কাঁচাগোল্লা।


নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে কাঁচাগোল্লার নাম। তাই কাঁচাগোল্লার নাম শুনলেই নাটোর এবং নাটোর নামটি শুনলে সবার আগে চলে আসে কাঁচাগোল্লার নামটি। নাটোর ও কাঁচাগোল্লা যেন একই সূত্রে গাঁথা। এখন সেই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কাঁচাগোল্লা দেশের ১৭তম নিজস্ব জিআই পণ্য।


গত মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরে নাটোর জেলা প্রশাসকের নামে কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি অনুমোদন দেয়া হয়।


বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) দুপুরে জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।


প্রায় ২৬৩ বছর পর সুস্বাদু মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন নাটোরের সাবেক ও রাজাশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ।


গত ৩০ মার্চ এফিডেভিটের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মাধ্যমে নাটোরের কাঁচাগোল্লার জিআই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।


জানা যায়, ১৭৬০ সালের কিছু আগে তৎকালীন নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকান ছিলো এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দোকান। দোকানের বড় বড় চুলায় মধুসূদন পাল প্রতিদিন দেড় থেকে দুমণ ছানা দিয়ে পানতোয়া, চমচম, কালো জাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনেরজন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। সৃষ্টি হয় এক নতুন মিষ্টান্ন, যার নাম দেয়া হয় কাঁচাগোল্লা।


১৭৬০ সালে বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা মহারাণী ভবানী রাজত্বকালে এই কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজ পরিবার পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র।


ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছিল। তবে এ নিয়ে নাটোরের মানুষের করণীয় কিছুই ছিল না। চার পুরুষ ধরে মিষ্টি ব্যবসার সাথে জড়িত নাটোরের ঐতিহ্যবাহী জয় কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।


জিআই স্বীকৃতির ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এই দোকানের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী প্রভাত কুমার পাল বলেন, জিআই আবেদন অনেক আগেই করা দরকার ছিল। কেননা বিভিন্ন রকমের মানহীন মিষ্টি কাঁচাগোল্লা নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। এতে নাটোরের সুনাম নষ্ট হয়। এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিকৃত আকারে উৎপাদন বন্ধ হবে। দেশের মানুষ আসল কাঁচাগোল্লা চিনে কিনতে পারবে।


নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী বলেন, কাঁচাগোল্লা জিআই তালিকাভুক্তি হল। এর মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশ বিদেশে কাঁচাগোল্লার ব্র্যান্ডিং ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এ সংক্রান্ত যে কোন উদ্যোগে পৌর কর্তৃপক্ষ পাশে থাকবে।


নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, নাটোরের কাঁচাগোল্লার ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বিদায়ের পূর্বক্ষণে জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। অবশেষে জিআই স্বীকৃতি এলো।নাটোরের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের স্বীকৃতি আদায়ে ভুমিকা রাখায় আনন্দিত বোধ করছি।


নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঞাঁ বলেন, নাটোরের ঐতিহ্যবহনকারী জনপ্রিয় এ কাঁচাগোল্লা এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে আমরা ও নাটোরবাসী গর্বিত। ভবিষ্যতে কীভাবে বিশ্বব্যাপী কাঁচাগোল্লার প্রসার ঘটানো যায়, সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্ত বাইরে বিকৃত আকারে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় বলে বিভিন্ন সময় শোনা যায়। কেউ যাতে এ পণ্যকে বিকৃত করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে। জেলা প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এই বিকৃতি রোধ করা হবে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com