ইসির সঙ্গে সংলাপ: নির্বাচনি কর্মকর্তা বাছাইয়ে সতর্ক থাকার সুপারিশ
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২২:৪২
ইসির সঙ্গে সংলাপ: নির্বাচনি কর্মকর্তা বাছাইয়ে সতর্ক থাকার সুপারিশ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জামানত ও নির্বাচনি ব্যয়সীমা কমানো এবং প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ এসেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে।


নির্বাচনি কর্মকর্তা বাছাইয়ে সতর্ক থাকা, ৩০০ আসনেই ‘না’ ভোটের বিধান রাখা কিংবা মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে কমিশনের সমন্বয়সাধনের মতো পরামর্শও দিয়েছেন কেউ কেউ।


১৩ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার দুপুরে আগারগাঁওয়ে ইসি ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ছয়টি রাজনৈতিক দলের সংলাপে এসব সুপারিশ ও মতামত উঠে আসে।


বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল— জেএসডি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে এ সংলাপ হয়।


প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অন্যান্য কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা এ সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।


সূচনা বক্তব্যে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতা কামনা করেন।


তিনি বলেন, “ভোটাররা বা রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের অন্যতম অংশীদার। ভোটারদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার করা আপনাদের (রাজনৈতিক দলগুলোর) দ্বারাই সম্ভব।


“৫৩ বছর হলো, আমরা একটা নির্বাচনই করতে পারলাম না, এটাই আমার কাছে লজ্জার মনে হয়।”


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার আগে ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আগের কোনো কমিশনকে এটা সামলাতে হয় নাই। এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) অপব্যবহার আগে সামলাতে হয়নি। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে।”


সংলাপের শুরুতে কথা বলেন সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন।


তিনি প্রার্থীর জামানত কমিয়ে ১০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করে বলেন, “দেশের বেশির ভাগ মানুষ গরিব; আমরা তাদের কাছে যাই ভোটের জন্য। কিন্তু তারাও যে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে, সে বিবেচনা করি না। যদি তা করতাম, তাহলে জামানতের টাকা ৫০ হাজার করতাম না।”


আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে উদ্বেগ জানান তিনি।


নির্বাচনি ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিলেও তা কমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আপনারা বলবেন তফসিল ঘোষণার পর থেকে হিসাবটা করতে চাচ্ছেন। কিন্তু বিফোর ইলেকশন, শত শত কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, না তা বিবেচনা করবেন।”


ভোট সুষ্ঠু করতে এক উপজেলায় কর্মরত শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের অন্য উপজেলায় নির্বাচনি দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফী রতন।


তিনি বলেন, “একটা উপজেলার প্রাথমিকের শিক্ষক, হাই স্কুলের শিক্ষক বা কলেজের শিক্ষক, তারা ভোট নিচ্ছেন। তাদের প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতমূলক মনোভাব থাকতে পারে। ফলে এটা করা দরকার। যেহেতু আপনারা পোস্টাল ব্যালটের আয়োজন করছেন, সে কারণে একই উপজেলার শিক্ষকদের অন্য উপজেলায় ভোট গ্রহণ করালে আমার মনে হয় আরেকটু ফেয়ার ইলেকশন হতে পারে। এটা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি।”


জেএসডির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তানিয়া রব নির্বাচনের দিন স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় নিশ্চিত করতে কমিশনের কাছে নানা সুপারিশ তুলে ধরেন।


তিনি বলেন, “আমরা যখন একটি ঘটনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে যাই, তখন বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেটকে বলুন, অমুককে বলুন। স্থানীয়ভাবে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল; সেখানে আমি ম্যাজিস্ট্রেট পাব কোথায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কাউকে পাব কোথায়।”


ভোট কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশ করে তিনি বলেন, “স্থানীয়ভাবে প্রিজাইডিংদের যে নিয়োগ দেওয়া হয়, তারা সবাই থাকে ওইখানে। তাদের আত্মীয়-স্বজন থাকেন। সব মিলিয়ে নির্বাচনে প্রিজাইডিংদের মধ্যে দিয়ে যে নিরপেক্ষতা আশা করা হয়, সেটি হয় না। বেশি দূরে না গিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও যদি (প্রিজাইডিং অফিসার) আসে, তাহলেও কিছুটা পক্ষপাতমুক্ত নির্বাচন হতে পারে।”


জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, “যারা সত্যিকার অর্থে জনগণ নিয়ে ভাবেন, জনগণের সঙ্গে থাকেন, যারা টাকার মালিক নন, সেই মানুষগুলো নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে শতমাইল দূরে। তারা কল্পনাতেও চিন্তা করতে পারে না, একটা খেটে খাওয়া মানুষ, সাধারণ মানুষ, সমাজসচেতন ব্যক্তি এ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন, জনগণের কাছে ভোট চাইবেন। শত ‘হুন্ডার’ কথা বলেছিলাম, এখন হাজার ‘হুন্ডা’। গুন্ডা শব্দটা আমি বলতে চাই না।”


আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত যাহা আমরা দেখছি, তাতে সেটি হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখছি না। এটি মূলত সাদা ও কালো টাকার মিলনে একটা মহোৎসবে পরিণত হবে।”


জামানতের টাকা ও নির্বাচনি ব্যয়সীমা বাড়ানোর সমালোচনা করে বাসদের সভাপতি বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এ সিদ্ধান্ত সংসদকে কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত করবে।”


তিনি জামানত কমিয়ে ৫ হাজার টাকা ও নির্বাচনি ব্যয়সীমা ৫ লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানান।


আরপিওতে একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান তুলে ধরে তিনি বলেন, সব আসনে ‘না’ ভোটের বিধান রাখা যেতে পারে।


সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারো বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হলে কিংবা আদালত কাউকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।


এ বিধানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “তা নাগরিকের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থি বলে আমরা মনে করি। যতক্ষণ বিচার সম্পন্ন হয়ে আদালত কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত না করে, ততক্ষণ কারো প্রার্থিতা অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে না। অভিযুক্ত ও দোষী এক জিনিস নয়।”


অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের আগামী নির্বাচন থেকে বিরত রাখার বিধান জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন,“অন্যথায় সরকার ও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”


নির্বাচন কমিশনকে কোনো ‘অযৌক্তিক’ চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার আহ্বান জানিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, “দৃঢ়চিত্ত, বলিষ্ঠ ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আমরা দেখতে চাই।”


জামানত পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে রাখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে আনার সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, “কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। এটা আপনাদের জুরিসডিকশনের মধ্যেই পড়ে। প্রয়োজনে আলোচনার মাধ্যমে আরও বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার। অন্যথায় আস্থা তৈরি হবে না।


তিনিও ৩০০ আসনে না ভোটের বিধান রাখার সুপারিশ করেন।


সংলাপে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “আগে আচরণবিধি স্পষ্টভাবে আরপিওর সঙ্গে যুক্ত করা ছিল না। এটাকে সরাসরি আচরণবিধির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। আমরা পুরো আসনের ফল বাতিল করতে পারব এবং ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে পারব।”


ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহের টাইমলাইন না দিলেও দুই সপ্তাহের টাইম লাইন দিয়ে দিয়েছি।”


কোনো ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করে কিংবা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে নির্বাচন আয়োজনের পথে কমিশন হাঁটবে মন্তব্য করে ইসি সানাউল্লাহ বলেন, “আমাদের অপতথ্যকে সঠিক তথ্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।”


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নির্বাচনি দায়িত্ব পান, তাই এসব প্রতিষ্ঠান প্রচার-প্রচারণার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তুলে ধরে সানাউল্লাহ বলেন, “কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা সদস্য ভোটে দাঁড়ালে তাকে ওই পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে নমিনেশন সাবমিশনের আগেই।”


এদিন সকালে প্রথম ধাপে আরও ছয়টি দলের সঙ্গে সংলাপ চলে ইসির। দুই ঘণ্টার সেই সংলাপে অংশগ্রহণ করে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।


নির্বাচন প্রস্তুতির মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে অংশীজনদের সঙ্গে ইসির মত বিনিময় শুরু হয়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণভোট, জোট করলেও ভোটের প্রতীক, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটিং পদ্ধতি, আইন-বিধি সংস্কার ও প্রতিপালন, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিসহ নানা বিষয় উঠে আসে আলোচনায়।


ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে ইসির। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন সেদিকে তাকিয়ে আছে।


বর্তমানে বিএনপি, জামায়াতসহ ৫৩টি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এবার এনসিপিসহ নতুন তিনটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে নির্বাচন কমিশন।


এ ৫৬টির বাইরে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে ও পুরনো তিনটি দলের নিবন্ধন বাতিল রয়েছে।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com