বৈঠকের পর দলগুলোর ক্ষোভ, সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০০:৫৩
বৈঠকের পর দলগুলোর ক্ষোভ, সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

অন্তর্বন্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।


মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে চার দলের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন বুধবার (২৩ জুলাই) ১২টি রাজনৈতিক দল এবং একটি জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউনূস।


আগের দিন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সঙ্গে বসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।


২৩ জুলাই, বুধবার তিনি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, এবং ১২ দলীয় জোটের নেতাদের ডাকেন।


‘বড় দল’, ‘ছোট দল’ আলাদা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। অনিবন্ধিত এনসিপি কী করে বিএনপির মত দলের সঙ্গে এক দিনে ডাক পেল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন একজন।


বৈঠকে দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘দুর্বলতা’ নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে। সরকার কেবল সংকটে পড়লেই তাদের ডাকে—এমন কথাও বলেছেন নেতারা।


একটি দলের প্রতি সরকারের ‘পক্ষপাতমূলক’ আচরণ, বিচার ও নির্বাচন সংস্কারের ‘ধীর গতি’, এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যেমন গোপালগঞ্জ ও মাইলস্টোনের ঘটনা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।


দলগুলো জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, দুর্নীতি দমন, এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে।


তারা প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়মিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার, একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।


এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “আমাদের যে জাতীয় ঐক্য হওয়া দরকার ছিল। আমরা যে বিপদের মধ্যে ছিলাম শেখ হাসিনার আমলে, শেখ হাসিনার পতনের পরে আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছি। সেই ভাগ হচ্ছে কেউ কেউ এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন এবং সেটাকে একটা প্রিভিলেজ হিসেবে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন যে আমাদের মধ্যে একটা অনৈক্য তৈরি হয়েছে। বিভেদ তৈরি হয়েছে।”
এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ''আমরা বলেছি, আপনি শুধু বিপদে পড়লে—শুধু একটা ঝামেলা হলেই আপনি আমাদেরকে ডাকেন। এবং আমাদের অনেক কথা থাকে—যে কথাগুলো আমরা আপনার এখানে, বিশেষ করে বলতে পারি না। কারণ অনেকগুলো দল থাকে, আমাদের দুই-চার মিনিট করে কথা বলার সুযোগ হয়।''
১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ''আমাদেরকে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার কথা বলেছি। আমরা বলেছি, অতীতে বারবার আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বলা হয়েছে যে আপনি উপদেষ্টা মণ্ডলীতে সংস্কার করুন। যোগ্য এবং দক্ষ উপদেষ্টাদের আপনি আপনার উপদেষ্টা পরিষদে সংযুক্ত করুন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “শুধু এ ধরনের সংকটে যার যার দায়িত্ব পালন করবে, হুটহাট করে ডাকলে সবসময় আসবে, এমন না। কিন্তু আজকে যখন বললেন, আমরা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করলাম এজেন্ডা কী? উনারা বললেন, এজেন্ডা হচ্ছে এখন দেশ একটা সংকটপূর্ণ আছে। এই সংকটে করণীয় কী? এইটা হবে এজেন্ডা।”
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে গঠিত। কাজেই এই সরকারের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা এবং এই সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, জনগণের যে প্রত্যাশা—সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে এই সরকারকে এগোতে হবে। এইটা আমরা বলেছি।
ফিরোজ বলেন, “এই সরকার যখন খুব বিপদে পড়ে, আর সামলাতে পারছে না, টালমাটাল অবস্থা এবং মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে—তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে, আমাদেরকে ডেকে এখানে দেখায় যে, ‘এরা সবাই আমার সাথে আছে’। আমরা এই সরকারকে সমর্থন করেছি ঠিক, কিন্তু অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী কোনো কাজ করলে আমরা এই সরকারকে সমর্থন করব না, তার বিরোধিতা করব, সমালোচনা করব। আর অভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে যদি কাজ করে, আমরা সেটাকে সমর্থন করব—সেটা আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “একটা দল—সেটা নতুন দল, এখনো নিবন্ধিত দল না। ছাত্ররা এই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের সম্মান আছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, ভালোবাসা আছে, স্নেহ আছে। কিন্তু তার মানে এই না, অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈষম্য তৈরি করে একটা দলকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “আমাদের দিক থেকে যে কথাটা আমরা শুরুতে স্পষ্ট করে বলেছি, আপনি গতকাল থেকে এবং আজকে যে অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় করছেন... সরকার প্রধানের উচিত ছিল লন্ডন থেকে ফেরার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করা, সবাইকে আস্থার মধ্যে নেওয়া।


“আমরা বিচার সংস্কার এবং নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছি, আপনার উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা আস্থা-ভরসার সম্পর্কটা তৈরি করা। সেই কাজটা বাস্তবে সরকার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে, দেশটায় অনাকাঙ্ক্ষিত একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং আমরা লক্ষ্য করেছি, এই সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে—আমরা বলেছি—আপনি সবচেয়ে জননন্দিত রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে সমর্থিত সরকার হলেও মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে দুর্বল সরকার। যে কারণে দেশে একটা আধা-নৈরাজ্যিক অবস্থা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে।”


এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন, “আমাদের দেশে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে, সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি যে—আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে একতা এবং ঐক্য ছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে আজকে এই একতা এবং ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে।


তিনি বলেন, “এই সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে, তারা এটা মানুষের সামনে ধরে রাখতে পারেনি। তাদের মধ্যে নানা রকম কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে মানুষ আজকে তাদের উপর আর সেই বিশ্বাস রাখতে পারছে না। তারা এই দেশের সবচেয়ে দুর্বল সরকারের একটা পরিচয় দিয়েছে। এবং দুর্বল সরকার পরিচয় দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল—তারা সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।


গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, সেইদিকে আরো অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে।


সাম্প্রতিক ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রসঙ্গ ধরে সাকি বলেন, “যেভাবে আমরা সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা বিক্ষোভ দেখছি, আমরা বিক্ষোভের প্রতি সংযম প্রদর্শন এবং ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের কাছে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, মানুষের বিক্ষোভ থাকবে এবং সেই বিক্ষোভ প্রকাশের যে অধিকার—সেটা থাকতে হবে। কাজেই ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। সাম্প্রতিক ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রসঙ্গ ধরে সাকি বলেন, “যেভাবে আমরা সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা বিক্ষোভ দেখছি, আমরা বিক্ষোভের প্রতি সংযম প্রদর্শন এবং ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের কাছে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, মানুষের বিক্ষোভ থাকবে এবং সেই বিক্ষোভ প্রকাশের যে অধিকার—সেটা থাকতে হবে। কাজেই ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।


গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বলেন, “আমরা সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলই সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণ এবং পক্ষপাতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ দেখিয়েছে। কারণ ধরেন, বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। তাদের এখনো রাজনীতির মাঠে একটা শক্ত অবস্থান আছে। সেই ক্রাইটেরিয়ায় বিএনপির মত একটা বড় দলের সাথে সরকার আলাপ করতে পারে।


“কোন ইস্যুতে সে চারটা দলকে কোন ক্রাইটেরিয়ায় বড় দল কিংবা প্রধান দল হিসেবে তারা সিলেক্ট করল? এবং তার মধ্যে একটা দলে তো নিবন্ধনই নাই, সদ্য গঠিত হয়েছে। এবং এই অভিযোগটা মোটামুটি বৈঠকে যারা উত্থাপন করেছেন, বাকিরাও সমর্থন করেছেন যে সরকারের কর্মকাণ্ডে এবং ভূমিকায় দেখা গেছে তারা এনসিপির প্রতি একটু পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করছে।”


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com