চলুন সাধারণ হই, মাটিতে পা রাখি
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:০৮
চলুন সাধারণ হই, মাটিতে পা রাখি
প্রফেসর ড. মো. নাসিরুদ্দিন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

সাত সকালে ঘন কুয়াশা ডিঙিয়ে চেক ইনের বিশাল লাইন দেখে হতাশ হই। বাংলাদেশ বিমানের একজন অ্যাসিস্টেন্ট লাল পাসপোর্ট দেখে আমায় একটু এক্সট্রা খাতির করলেন। পাশের ফাঁকা কিউ পেয়ে চেক ইনের কাজটা দ্রুত করে দিলেন।


এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, আশপাশের লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমি যেন চিড়িয়াখানার চতুষ্পদ কোনো জন্তু। ভাবলাম, এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ নিয়েছি, সেজন্য বোধ হয় লোকজন মাইন্ড করছে। ভিতরে ভিতরে ভাব আসার পরিবর্তে খানিকটা খারাপ লাগছিল। এত মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি কে হে কুদ্দুছ! ভিআইপি মর্যাদায় এক্কেবারে লাইনের পিছন থেকে সবার আগে চেক ইন করে ইমিগ্রেশনে চলে যাচ্ছি!


লাগেজ বুকিং সেরে ঘাড় ঘোরাতেই আমার ভুল ভাঙে। তাই তো এ তো মোশাররফ করিম! আমার ঠিক পিছনেই তিনি সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে আছেন। তাহলে কি লোকজন আমাকে নয়; তাকে দেখছিল অবাক হয়ে? যাক একরকম অপরাধবোধ থেকে আল্লাহ আমায় রক্ষা করেছেন।


‘ভাই, কলকাতার চেক ইন কোন কাউন্টারে? এটা তো সিঙ্গাপুরের লাইন?’ তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন। কাউন্টারের ঐ ভদ্রলোক প্রশ্ন শেষ না হতেই বললেন, ‘সমস্যা নেই। বাংলাদেশ বিমান তো। দিন আপনারটাও করে দিই’। শত চোখের নজর তখন মোশাররফ করিমের দিকে। আমি ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেই। এরপর ইমিগ্রেশনের লাইনে দেখা। তার লাইন ভিন্ন। আমার লাইন ভিন্ন। কথা বলার সুযোগ নেই। আমারটা ডিপ্লোমেটিক লাইন। তাই ভিড় নেই। তারটা অর্ডিনারি লাইন। তাই অনেক ভিড়।


কিন্তু কী আশ্চর্য! বলাকায় লাউঞ্জে এসে দেখি তিনি ও তাঁর স্ত্রী নাস্তা শেষে ডেসার্ট খাচ্ছেন। বুঝলাম ইমিগ্রেশনেও উনাদের এক্সট্রা খাতির করে দ্রুত সেবা দিয়েছে। লাউঞ্জে খুব একটা ভিড় নেই। একাকী আমি ভিতরের রুমে নাস্তা খাচ্ছিলাম। হাতে একটা সিগারেট নিয়ে আগ বাড়িয়ে মোশারফ করিম বললেন, লাইটার হবে? বললাম, ‘না, বাট ব্যবস্থা করে দিচ্ছি’। আমি তাজুল সাহেবকে একটা লাইটার দিতে বলি। তাজুল সাহেব আমার পরিচিত। মাঝে মধ্যে এখানে এলে বেশ খাতির যত্ন করেন। মোশাররফ করিম এবার আমার পাশেই বসলেন।


এক কাপ কফির সাথে দুইটা সিগারেট পরপর ফুঁকলেন। ফাঁকে জুড়ে দিলেন গল্প। বরিশালের গৌরনদীতে জন্ম তার। কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে তার নিজের প্রযোজিত ছবি মুক্তি পাচ্ছে। নামটাও বলেছিলেন কিন্তু মনে করতে পারছি না। দুইদিন পর দেশে ফিরবেন। আলাপকালে জানতে চাইলেন, আমি কি করি? গল্পচ্ছলে জানালেন, সিঙ্গাপুরে তিনি কক্ষণো আসেননি। তবে দাওয়াত পেলে ভাবিসহ আসবেন। সাদামাটাভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, পরামর্শ আছে কি না তার অভিনয় নিয়ে। হাক ডাক না রেখে আমিও বলি, ‘আপনার অভিনয় আমার ভালো লাগে। দারুণ হাসির খোরাক জোগায়। বললাম, আমার পরিবার আপনার অভিনয়ে মুগ্ধ। তবে এখন আর সব নয়। অতিমাত্রায় সিলেক্টিভ কিছু চরিত্রে অভিনয়ের পরামর্শ দিয়েছি। তিনিও মাথা নেড়ে একরকম মেনে নিলেন। এর মধ্যে কলকাতাগামী বাংলাদেশ বিমানের অ্যানাউন্সমেন্ট চলে আসে। ভাবি স্মোকিং রুমে এসে ডাক দিতেই বললেন, কার্ড আছে আপনার? কার্ড দিতে দিতেই ভাবলাম আমার কন্যার প্রিয় অভিনেতার সাথে ফ্রেমে বন্দি হলে মন্দ কি? শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও কত মিলিয়ন মিলিয়ন লোকের মুখে তিনি হাসি ফোটান। তার সাথে একটু ফ্রেমে বন্দি হলে মন্দ কী? প্রস্থানের সময় ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েন।


দারুণ একজন ভালো মানুষ মনে হলো তাকে আমার। বিন্দুমাত্র অহংবোধ দেখিনি। দেখিনি কোনো প্রোটোকল। অথচ সবাই হাসিমুখে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তার কাজ দ্রুত করে দেন। তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। একটু কথা বলতে আকুতি ব্যক্ত করেন। তিনি কোনো ভিআইপি নয়। রাষ্ট্র তাঁকে তেমন কোনো সুবিধা বা সম্মান দিচ্ছে বলেও প্রতীয়মান হয় না।


কিন্তু যারা নিজেদের ভিআইপি মনে করে প্রোটোকলের হুইসেলে আমজনতাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে রাখেন; এয়ারপোর্টের এবিপিএন থেকে শুরু করে সিভিল অ্যাভিয়েশন, এয়ার ফোর্স, ফ্লাইট কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস, সকলকে তটস্থ রাখেন; জোর করে সালাম নেন। বাধ্যবাধকতার কারণে তাদের পরিষেবাগুলো ঠিকমতো দেয়া হলেও এই কাজে সংশ্লিষ্টদের কতটুকু আন্তরিকতা বিদ্যমান? মোশাররফ করিমের প্রতি মানুষের ভালবাসা দেখে এই প্রশ্নটিই আমার নিজের মনে একটি বড় জিজ্ঞাসা হয়ে আছে।


ক্যামেরার সামনের এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমরা অনেক ভালো-মন্দ সমালোচনা করি। অথচ ব্যক্তিজীবনে এরা অতি সাধারণ। দেশের সবাই তাদের চিনে ও জানে। মন থেকে ভালোবাসে। আসল সেলিব্রেটি তো তারাই। আমরা ক্যামেরার পিছনের মানুষ। নীরবে নিভৃতে কাজ করি। এয়ারপোর্টের এই ছোট্ট বিষয়টুকুন আমায় দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। সত্যি, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া বড় কঠিন কাজ! বড় কঠিন অর্জন এটি! অথচ সাধারণের মাঝেই এটি বিদ্যমান। এজন্য অসাধারণ কিংবা ভিআইপি হয়ে ওঠার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। চলুন মানুষকে ভালোবাসি। সাধারণ হই। মাটিতে পা রাখি।


লেখক : অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দিন মিতুল, ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। (ফেসবুকের ওয়াল থেকে)


বিবার্তা/এসবি/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com