শিরোনাম
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে তরুণদের আকুতি
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২১, ১১:১৯
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে তরুণদের আকুতি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় অবশেষে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অথচ পরীক্ষার পরপরই কর্তৃপক্ষ বলেছিলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই অস্বীকারের চারদিনের মাথায় গত রাতে পরীক্ষা বাতিলের কথা জানানো হলো।


অবশ্য এখন বাতিল না করে উপায় কী? পুলিশ তো সংবাদ সম্মেলন করে কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেটা জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই বাতিল হতেই হতো। কিন্তু এখন আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, এর আগে তাহলে কীসের ভিত্তিতে বলা হয়েছিলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রত্যেকবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের তদন্ত না করে কীভাবে বলে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি?


আপনাদের মনে করিয়ে দেই, গত ৬ নভেম্বরের এই পরীক্ষা দিতে এসেছিলো লাখখানেক প্রার্থী। হঠাৎ ডাকা ধর্মঘটের মধ্যে বহু কষ্টে ঢাকায় এসে তারা পরীক্ষা দিয়েছিলো। কিন্তু পরীক্ষা দেয়ার পরপরই তারা জানতে পারে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০০টি প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকজন সেটা ইনবক্সেও পাঠিয়েছেন আমাকে।


এর মধ্যে একজন নাম গোপন রাখার শর্তে যে স্ক্রিনশট পাঠালেন তাতে দেখেছি, পরীক্ষা বিকেলে হলেও হাতে লেখা উত্তরপত্রটি কাউকে পাঠনো হয়েছে বেলা ১২ টার পরপরেই। বুঝতে বাকি রইলো না প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কাজেই এ নিয়ে সবার আগে আমি লিখে পরীক্ষা বাতিল দাবি করেছি।


পরীক্ষার পরদিন রবিবার ২০-২৫ জন তরুণ বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানালেন। আশার কথা হলো, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এবার আগে থেকেই মাঠে নেমেছিলো। এই ঘটনায় জালিয়াতি চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের প্রতিবেদনে ইমরান প্রতিবেদন করেছে।


প্রার্থীদের অভিযোগের আঙুল ছিলো, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। অতীতে এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একাধিক অভিযোগ ছিলো। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামানকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগেও চক্রটি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছে।


পুলিশ বলছে, পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছে। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেয়া হতো। সব প্রমাণ সামনে এনে সংবাদ সম্মেলন করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ।


কতৃপক্ষের কাছে আমার জিজ্ঞাসা-কীসের ভিত্তিতে এর আগে বলা হয়েছিলো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। বারবার তারা একই কাজ কেন করে? কাকে তারা বাঁচাতে চায়? আরেকটি বিষয়। আমার ধারণা ছিলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর হবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম গণমাধ্যমেই খবরটি নেই। আমার প্রশ্ন, একটা পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো, ছেলেমেয়েরা প্রতিবাদ করলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ হলো অথচ বাংলাদেশের একটা গণমাধ্যমও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে নিউজ করেনি। কিন্তু কেন? কেন তরুণদের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে উপেক্ষিত? কেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগগুলো তদন্ত না করেই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলো বলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। কী দৈবশক্তিতে তারা এতো দ্রুত নিশ্চিত হয়ে যায় যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।


আমার বেশ মনে আছে, অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। ২০১৭ সালের ১৯ মে সকাল-বিকেল দুই বেলায় এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সকালে পরীক্ষা শুরুর আগেই ব্যাপক হারে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমি আগেই ছেলেমেয়েদের জানিয়ে রেখেছিলাম প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে যেনো আমাকে পরীক্ষা শুরুর আগেই জানায়। কারণ ওই বছরেরই ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিলো। আমাকে ছেলেমেয়েরা জানিয়েছিলো পরীক্ষার পরে।


আমি ওই ঘটনা অনুসন্ধান করে দেখেছি, পরীক্ষা শুরুর আগের রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন এমন কয়েকজন বিষয়টা স্বীকারও করেন। কিন্তু এই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। আমি এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নিউজ করতে থাকি। ছেলেমেয়েরাও আন্দোলন করে। তবুও কর্তৃপক্ষ অনড় থাকে। নানা ভাবে তারা আন্দোলন দমাতে থাকে। অনেককে আন্দোলন থামাতে চাকুরির প্রস্তাব দেয়া হয়। ছেলেমেয়েরা আমাকে জানালে আমি তাদের অনড় থাকতে বলি। বিষয়টি আদালতে গড়ায়। আমি সব স্বাক্ষ্য প্রমাণ ছেলেমেয়েদের দিয়েছিলাম পরে এই পরীক্ষা বাতিল হয়েছিলো।


যাই হোক এই ঘটনায় আমি একটা শিক্ষা নিই। আমি ঠিক করি পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেতে হবে যেনো আমি প্রথম আলোতে তুলে দিতে পারি। অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষার আগে আমি ছেলেমেয়েদের জানিয়েছিলাম প্রশ্নপত্র পেলে আমাকে যেন পরীক্ষার আগে আগে জানায়। পেয়েও গেলাম। সেদিন সকাল বিকেল দুই দফায় পরীক্ষা ছিল।


আমি পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রথম আলোয় নিউজ করলাম প্রমাণসহ। কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যেগাযোগ করলো। বরাবরেই মতো, কর্তৃপক্ষ অনড়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো অনেকেই যোগাযোগ করে। আমি তাদের বলি, এই পরীক্ষা বাতিল না হলে জাতির জন্য কলঙ্ক হয়ে থাকবে। অবশেষে প্রথমে দুপুরের পরীক্ষার আগে এবং পরে দুটো পরীক্ষাই বাতিল করা হয়। আমি তখন খুঁজতে থাকি বারবার কেনো একই ঘটনা ঘটে?


বিষয়টা আসলে টাকার। বেশির ভাগ নিয়োগ পরীক্ষা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে হয়। আউটসোর্স মানে, নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নেবে আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, কোন বিভাগ বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য দরপত্র ডাকে। একেকটি পরীক্ষা নেয়ার জন্য দেড় থেকে দুই কোটি টাকা পায় বিভাগগুলো। আর সে কারণেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তারা স্বীকার করতে চায় না।


আবার ভাইভার নামে আবার নিয়োগবানিজ্য হয়। ফলে একটা চক্র গড়ে ওঠে। শুধু ব্যাংক না সরকারি নানা নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়মিত ঘটনা। সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা সময়ে এইসব চক্রের অনেককেই গ্রেফতারও করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি করে তারা কোটি টাকা আয় করেছে। আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে অনেকেই সরকারের নানা দপ্তরে চাকুরি পেয়েছে। হতাশ হয়েছে বাকিরা।বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। এর সমাধান কী?


একদিকে যখন ব্যাংক বা সরকারি নানা নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে, উঠলেও বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা এখন আর শোনা যায় না। কী করে সেটা সম্ভব হলো? আমি নিজে এই ঘটনার স্বাক্ষী। পিএসসির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। কয়েকবার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন আমি পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান সা’দত স্যার এবং আহমেদুল কবির স্যারকে দিয়েছি। বিশেষ করে লিখিত পরীক্ষার। সেই পরীক্ষা পরে বাতিল হয়েছে।


আর পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক যে কোন মূল্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। দেশে তখন মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ধেকে সব ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারি। ওই সময় সাদিক স্যার ঠিক করলেন, বিসিএসের আট থেকে দশ সেট প্রশ্নপত্র করা হবে। কেউ জানবে না কোনটায় পরীক্ষো হবে। পরীক্ষার আগমুহুর্তে লটারি করে সিদ্ধান্ত হবে কোন প্রশ্নে পরীক্ষা হবে। পিএসসির মেম্বারদের বাইরে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি সেই লটারিতে উপস্থিত ছিলাম। দারুণ সিদ্ধান্ত ছিল। এরপর থেকে বিসিএসের আর কোন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।


আমার মনে হয়, সব নিয়োগ পরীক্ষায় এটা করা যেতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, এই যে প্রতি সপ্তায় সরকারি কোন না কোন নিয়োগের পরীক্ষার হয়, সারা বছর জুড়ে পরীক্ষা হয় এগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত। কারণ যতো বেশি পরীক্ষা ততো বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ, ঘুষ বানিজ্য, দুর্নীতি। ছেলেমেয়েদের বারবার আসা, বারবার টাকা খরচ।


আমি মনে করি এসব বন্ধ করে সব পরীক্ষা পিএসসির অধীনে হওয়া উচিত। এই যেমন এখন একটা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নন ক্যাডারের বিভিন্ন পদেও নিয়োগ দেয় তেমনি সারা বছরে ৪-৫ টি পরীক্ষা হতে পারে পিএসসির মাধ্যমেই। সব ধরনের ব্যাংকের জন্য একটা, কারিগরী পদের জন্য একটা, সাধারণ পদের জন্য একটা এমন করে বছরে পাঁচ থেকে দশটা পরীক্ষা হতে পারে।
এখন যেমন এক বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে নন ক্যাডারে নানা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, ব্যাংকগুলো যেভাবে সমন্বিত পরীক্ষা নিচ্ছে সরকারের নানা বিভাগ ও দপ্তরগুলো সমন্বয় করে পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে। সাধারণ নবম গ্রেডের কর্মকর্তা পদ দিয়ে সরকারি চাকুরি শুরু হয়। কাজেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলোকে কয়েকভাগে ভাগ করে পাঁচ থেকে দশটি পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ ও অপেক্ষমান তালিকা প্রকাশ করে রাখা যেতে পারে।


শুধু কর্মকর্তা পদ নয় কর্মচারী বা নিচের দিকের পদেও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বছরে পদের ধরন অনুযায়ী জাতীয়ভাবে পাঁচ থেকে দশটা নিয়োগ পরীক্ষা হতে পারে। এরপর অপেক্ষমান তালিকা বা প্যানেল করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে ছেলেমেয়েদের দুর্ভোগ কমবে।


আরেকটি বিষয়। যে কোন ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে। এই যে বারবারের অস্বীকারের সংস্কৃতি সে কারণেই প্রশ্নপত্র বেশি ফাঁস হয়। কাজেই যে কোন প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠান সেই প্রশ্নপত্র করেছিল তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদেরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় নিতে হবে।


শুধু নিয়োগ পরীক্ষা নয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতেই হবে। একটা দেশের তরুণ প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচাতে হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের কোন বিকল্প নেই। আর সেই দায়িত্ব তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে সবাইকে। নয়তো এই জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার!


(শরীফ হাসানের ফেসবুক থেকে)


বিবার্তা/এমবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com