
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিদের এখতিয়ারবহির্ভূত কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ২৮ ডিসেম্বর, রোববার শিক্ষকদের এই প্ল্যাটফর্মের এক বিবৃতিতে এ ধরনের তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, তরুণ রাজনীতিবিদ ওসমান হাদিকে ১২ই ডিসেম্বরে গুলিবর্ষণ ও ১৮ই ডিসেম্বরে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর হতাশাজনক ও বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী একের পর এক অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, অথচ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে শীর্ষস্থানীয় দু’টি দৈনিক - প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে এবং দু’টি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান - ছায়ানট ও উদীচীতে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ডেইলি স্টারে আগুন দিয়ে আটকে রাখা সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে যাওয়া প্রখ্যাত সাংবাদিক-সম্পাদক নূরুল কবিরকে হেনস্থা করা হয়েছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস নামের এক যুবককে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা এবং প্রকাশ্যে তার মরদেহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে বাইরে থেকে তালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয় তাঁর দুই সন্তান আয়েশা ও সালমা আক্তার শিল্পীকে। এছাড়া রাজশাহীর বাগমারাতে চুরির মিথ্যা অভিযোগে ভ্যানচালক ওমর ফারুককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক যেমন ওসমান হাদীকে হত্যার বিচার চেয়েছে, তেমনি উত্তাল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দঙ্গল পাকিয়ে অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের প্রতিটি ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, এই বিবৃতির মাধ্যমে আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিদের এখতিয়ারবহির্ভূত কার্যক্রমের নিন্দা জানাচ্ছি এবং এ ধরনের তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
এতে বলা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারের নেতৃত্বে নানা ধরনের মবপ্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ডিনদের পদত্যাগ করানো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের হয়রানি তৎপরতা চলমান আছে। আপনারা সকলেই জানেন, নির্বাচিত ডিনদের সময়সীমা শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সুচারুভাবে ভর্তিপরীক্ষা সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন বিভাগে চিঠি দিয়ে তাদের ডিনশিপ আরও কয়েক মাস বর্ধিত করার বিষয় অবহিত করে। কিন্তু রাকসুর জিএস প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি না চেয়ে বরং ডিনদের পদত্যাগ দাবি করেন। কেবল তাই নয় নিজেই যেন ‘প্রশাসন’ হয়ে অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় ডিনদের বিরুদ্ধে হুমকি দেন, এমনকি এখতিয়ারবহিভূতভাবে নিজে পদত্যাগপত্র লিখে এনে বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে ডিনদের খুঁজতে থাকেন, সম্ভবত লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে অবাক বিষয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১২ জন ডিন। সকলেই গত আওয়ামী শাসনামলে নির্বাচিত। কিন্তু বাকি ৬জন হয়তো জিএসের বিবেচনায় ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় উত্তীর্ণ’ ফলে তাদের পদত্যাগের দাবি ওঠেনি, তাদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলাও হয়নি। এই উদ্ভূত অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে ’প্রগতিশীল শিক্ষক’ হিসেবে পরিচিত ৬জন ডিন দায়িত্ব পালতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আরো বলা হয়, এ ঘটনার সংবাদ পরিবেশনায়ও আমরা চতুর কৌশল লক্ষ করি। প্রথমত, প্রশাসনই চেয়েছিল তারা আরও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করুক। দ্বিতীয়ত, তারা স্বেচ্ছায় পদ ধরে রাখতে চেষ্টা করেননি, বরং অব্যাহতিই চেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুরোধেই তারা বাড়তি সময় দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনাটি পরিবেশিত হয় এভাবে যে ‘চাপের মুখে পদত্যাগ করলেন ডীনগণ’। এটাও আরও অসম্মানিত করার কৌশল হিসেবেই আমরা পাঠ করতে পারি। এখানেই শেষ নয়, ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে রাকসুর জিএস ভব্যতার সকল সীমা ছাড়িয়ে বারবার ঘোষণা করতে থাকেন, লীগপন্থী শিক্ষকদেরকে ক্যাম্পাসে ঢুকলে ‘কলার ধরে টেনে এনে প্রশাসন ভবনের সামনে বেঁধে রাখা হবে।‘ উপরন্তু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসুর ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ঘোষণা করেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রকার আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শিক্ষক ক্লাসে আসতে পারবে না।’ তিনি রাজশাহীর ভারতীয় হাইকমিশন উচ্ছেদেরও উসকানি দেন। বলা বাহুল্য, এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাই দেখা যায় রাকসু ও শিবিরনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে ‘হেইট স্পিচ’ ছড়ানো হতে থাকে। ফলে ক্যাম্পাসে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয় যা এখনো জারি আছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি, রাকসু ও তার নেতাদের এরকম অভব্য ও সন্ত্রাসী আচরণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি, যদিও এগুলো ফৌজদারি অপরাধের সামিল। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যা করছেন তা রাকসুর এখতিয়ারবহিভূত এবং তাদের আচরণও আগ্রাসী ও সন্ত্রাসীদের মতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমরা এর জবাবদিহি প্রত্যাশা করি। কেননা, রাকসুর নেতৃবৃন্দের এরকম আচরণ কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেনি, এটা সরাসরি বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার ওপরে হামলা। এর ‘স্পাইরাল ইফেক্ট’ পড়েছে সারা দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে।
এতে বলা হয়, এছাড়া ১৮ ডিসেম্বর ওসমান হাদির মৃত্যুর পরে, রাকসুর ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান উদীচী ও ছায়ানটকে তছনছ করে দেয়ার আহ্বান জানালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে জনপরিসরে অস্থিরতা ও মবসন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। আর আমরা এও লক্ষ করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত একজন শিবির নেতা সরাসরি হামলায় যুক্ত ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, ১৮ ডিসেম্বর রাতে অগ্নিসন্ত্রাসের পেছনে অন্য আরো উসকানিদাতার পাশাপাশি রাকসু ও জাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এবং ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দও একই ধরনের অপরাধ করেছেন। পাশাপাশি, ক্যাম্পাসগুলোয় ভীতিকর এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ডাকসুর প্রতিনিধিরা অতীতেও ক্যাম্পাসে পুলিশিং ও শিক্ষকদের উপর শারীরিক হামলা করে নিন্দিত হয়েছে।এসমস্ত সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, মবসন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে জনমনে এমন ধারণাই স্পষ্ট হয়েছে যে, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একের পর এক ঘটনাসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত ও পূর্বপরিকল্পিত। এসব পরিকল্পনা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইউটিউবারের ও মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। তারপরও সরকারের আইন শৃঙ্খলা ও দেশরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী এগুলো আমলে না নিয়ে দর্শকের ভূমিকা পালন করে এসেছে। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিয়ে মুক্তগণমাধ্যম, নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছিলেন। অথচ জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তীসময়ে নানা ঘটনায় মাজার ভাঙা, মবসন্ত্রাস, লোকশিল্পী ও বাউল গানের অনুষ্ঠানে হামলা, ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, ব্যক্তি এবং সংস্থার ওপর আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত চলেছে। কিন্তু সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮ই ডিসেম্বরের রাতের অগ্নিসন্ত্রাস এবং ভালুকায় দীপু হত্যার ঘটনায় সরকার কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। আমাদের জোর দাবি, ওসমান হাদির হত্যাকারীকেও সরকার দ্রুত গ্রেফতার করবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র প্রতিনিধি ও একটি বিশেষ দলের সদস্যদের উৎপাত ও এখতিয়ার বহির্ভূত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামিকেও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাদের অপতৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের মতো জড়িতদের ‘ব্যক্তিগত’ মতামত বলে দায়মুক্তি দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসী কাজের উসকানি দেয়া অপরাধ। রাকসু, জাকসু ও ডাকসুর যেসব নেতারা উসকানি ও সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]