ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের মূলমন্ত্র: জয়শ্রী দাস
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ১৫:০৭
ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের মূলমন্ত্র: জয়শ্রী দাস
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

‘ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়’


রবিঠাকুরের এই কথাগুলো যেন তাকে নিয়েই বলা। সর্বক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকে। হাসি তার প্রাণ, হাসি তার উদ্দীপনা, হাসিতে তার কর্ম ও সাফল্যের শক্তি। জানতে চাইলে বলেন, হাসিই জীবন, হাসতে হাসতে কঠিন কাজটা সহজে করে ফেলি আমি। হাসির সাথে সুন্দর জীবনের সম্পর্ক। হাসতে না পারলে কাজই করতে পারবো না, সাফল্য পাওয়া তো সম্ভব নয়ই। কথাগুলো বলছিলেন বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক কথাসাহিত্যিক জয়শ্রী দাস।


ছোটোবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী জয়শ্রী দাস। শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনে সবসময়ই রেখেছেন সাফল্যের ছাপ। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্যে ভীষণ অনুরাগ তার। সাহিত্যে অবদানের জন্য কথাসাহিত্যিক জয়শ্রী দাস অতি সম্প্রতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার। সাফল্যের ঝুলিতে আছে সোনার বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, বাঙালি সাহিত্য পুরস্কার, বিজয় টিভি বাংলাদেশ এক্সেলেন্সি অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অফ বাংলাদেশ (ট্রাব) বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফর ফিউচার অ্যাওয়ার্ড।




জয়শ্রী দাস মেধার পরিচয় দিয়ে কৃতিত্বের সাথে পটুয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও একেএম কলেজ, পটুয়াখালী থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ‘মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা’। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে পিএইচডি গবেষণারত।



পটুয়াখালী জেলা সদরের সত্যরঞ্জন দাস ও সুনীতি সুধা দাসের ছোট মেয়ে জয়শ্রী দাস। তারা দুজনই শিক্ষক ছিলেন। বাবা বাংলা এবং মা রসায়নের অধ্যাপক। পটুয়াখালী শহরে তাদের দোতলা বাড়ি, বাড়িতে বড় একটি লাইব্রেরি। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র হওয়ায় তার সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার বই। বাড়ি বইয়ের গন্ধে ভরপুর। সবার ছোট এবং ভাই-বোনদের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান থাকায় বই ছাড়া তেমন কোনো সঙ্গী ছিল না তার। বই পড়তে পড়তেই এক সময় নিজের ভেতর থেকে লেখার তাড়না চলে আসে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা শুরু হয় তার।



জয়শ্রী দাস বলেন, আমি বড় হয়েছি বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে, বাড়িভরা বই ছিল শুধু। যেহেতু বাড়িতে শুধু বই, আমরা পড়তামও বই। সারাদিন বই পড়া। তবে দুরন্তও ছিলাম বেশ, সারাদিনই দৌড়ঝাঁপ, মারামারি এসবেই দিন কাটত। বই পড়ার পর একটা অ্যাডভেঞ্চারাস ভাব চলে আসে। সেটা তো অ্যাপ্লাই করতে হবে, আর তাই সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। আবার ফিরে এসে বই পড়া।


প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায়-ম্যাগাজিনের সম্পাদনা ও গল্প লেখা শুরু করলেও প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের একুশের বইমেলায়। উপন্যাসটির নাম ‘একটি অন্যরকম গল্প’। ২০১৯ সালে ‘সে এবং দ্বিতীয়’, ২০২০ সালে ‘সদয় অবগতি’ প্রকাশ হয়। ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশ হয় ‘তুমি আছো কবিতা নেই’। ২০২২ সালের বইমেলায় ‘বিবর্ণ নয়নতারা’ নামে অনেকগুলো গল্প নিয়ে একটি গল্পের বই প্রকাশ হয়। মূলত তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখছেন এবং গবেষণার কাজ করছেন।



স্বামী উত্তম কুমার দাস পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তাদের দুটি সন্তান, বড় ছেলে ঋদ্ধি মনন এবং ছোট ছেলে আর্য অনুরণন। জয়শ্রী দাসের এক ভাই, পেশায় চিকিৎসক। তার নাম ডা. সিদ্ধার্থ শংকর দাস। দুই বোন। একজন অর্চনা মনি দাস। তিনি ব্যাংক কর্মকর্তা। অন্যজন অর্পিতা দাস- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে বর্তমানে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছেন। জয়শ্রী দাস সবার ছোট। তিনি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া গান শুনতে পছন্দ করেন। রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ, দেবব্রত বিশ্বাসের গান ও পুরোনো দিনের গান ভীষণ ভালো লাগে তার। প্রার্থনা সংগীত পছন্দ করেন। প্রিয় লেখকের তালিকায় আছে অসংখ্য নাম।


চাকরি ও সংসারের কাজের ব্যস্ততার মাঝে নিয়মিত লেখালেখি করার চেষ্টা করেন। গভীর রাতে লিখতে বেশি পছন্দ করেন। ব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখিতে সময় দেওয়া ও মনোনিবেশ কীভাবে করেন জানতে চাইলে জয়শ্রী বলেন, সকাল থেকে পরিকল্পনা নিয়ে আগাই। ঘুম থেকে উঠি সাড়ে চারটায়। তারপর কিছুক্ষণ ব্যায়াম করি। কাজ করতে হলে শরীরটাকে তো ভালো রাখতে হবে। এরপর সাতটার সময় বাচ্চাদের নিয়ে বের হই। তারপর অফিস। বিকালে ফিরে বাচ্চাদের সময় দেই। আর লেখা? আমার একটা বড় রুম আছে। মাঝে একটা টেবিল। সেখানে বসে লিখি। পাশেই বাচ্চারা খেলা করে, আমি লিখি। অসুবিধা হয় না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বাজার ছাড়া লিখতেই পারি না! হা হা হা... আসলে কোলাহল তার লেখায় কোনো সমস্যা তৈরি করে না, এমনটাই বোঝাতে চেয়েছেন জয়শ্রী। আসলে জীবনকে সহজ করে নেওয়ার এক অসম্ভব ক্ষমতা আছে তার। তিনি এও বলেন, আমি একা কোনো কাজ করি না, সবাইকে নিয়ে করি। আর এতেই সাফল্য সুনিশ্চিত।



এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের ব্যস্ততার শেষ নেই। ব্যস্ততার মাঝেই নিজের একান্ত কিছু কাজ করতে কিন্তু সবাই ভালোবাসে। সে কাজটা মানুষ মনোযোগ দিয়ে করে এবং তা আপন ইচ্ছায় করে ফেলে। আমারও লেখালেখির মাঝের সময়টা খুব ভালো কাটে। লেখা শেষ হলে বুঝতে পারি, আমাকে দিয়ে কে যেন লিখিয়ে নিয়েছে।’



জয়শ্রী দাস মনে করেন, একজন নারীর মধ্যে জাগরণ তখনই সহজতর ভাবে সম্ভব যখন পরিবার তাকে সাপোর্ট দেয়, আশেপাশের সবাই সাপোর্ট দেয়, অনুকূলে থাকে সমস্ত আয়োজন, হাওয়া থাকে সেই নারীর জীবনের দিকেই। এই সব কিছু যখন একসাথে হয়, তখনই নারীটি নিজেকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারে, আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি আমার পরিবার থেকে খুব সাপোর্ট পেয়েছি, পাচ্ছি এখনো।



সমাজে নারীদের এগিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সমাজের প্রতিটি নারীকে শ্রদ্ধা করতে হবে। একই সঙ্গে নারীকে হতে হবে কর্মময়।' তিনি মনে করেন, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, মনোভাবের পরিবর্তন। আর নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে।



সাফল্যের মূলমন্ত্র কী ছিল জানতে চাইলে জয়শ্রী দাস বলে, সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে সব কিছুকে পজিটিভলি দেখা। আলোকে আলো বলা, অন্ধকারকে অন্ধকার বলা। আমি পৃথিবীতে সবকিছুকে খুব ভালোভাবে দেখি। ধৈর্য নিয়ে দেখি, করি। আমার দাদা খেলার সময় কারো সাথে মারামারি হলে বলতেন, তুমি কেন ওর সাথে মারামারি করছ, ও তো ভালো। এতেই যেন মগজ ধোলাই হয়েছিল। আমি এভাবে ভাবতে শিখেছি, সবকিছুই ভালো। আমি সবকিছুকেই ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে শুরু করি, আর এটাই সাফল্যের মূলমন্ত্র।



ইতিবাচক দৃষ্টিতে সব কিছু দেখা কঠিন কি না জানতে চাইলে জয়শ্রী দাস বলেন, এটা সাধনার বিষয়। ছোটোবেলা থেকেই যদি ভালোভাবে নেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়, তাহলে এটা খুব সহজ। আমি ছোটোবেলা থেকেই ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে বড় হয়েছি, এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার সবকিছুকে ভালো মনে হয়, সবকিছু আলোকিত মনে হয়। এটা আমার স্টাইল।



জয়শ্রী দাস অসাধারণ কর্মোদ্যম ও নিরন্তর সাহিত্য সাধনায় ইতোমধ্যে নির্মাণ করেছেন অপূর্ব এক শিল্পভুবন। মানুষকে জাগ্রত করেন তার লেখা দিয়ে। তিনি ইতিবাচক এক পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। যেখানে সবাই সবকিছুকে ভালোভাবে দেখবে, ভালোভাবে গ্রহণ করবে, পরস্পরের প্রশংসা করবে, মানুষ মানুষের জন্য মঙ্গল কামনা করবে, হিংসা-বিদ্বেষ যেখানে স্পর্শ করবে না মানুষের মন। সুন্দর ও আলোকে উদ্ভাসিত হবে এক কর্মময় ও প্রেমময় পৃথিবী।


বিবার্তা/এসবি/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com