
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পঙক্তিমালার মতোই মৃন্ময়-চিন্ময় অথচ জাহান্নামের আগুনে বসে হাসতে পারেন পুষ্পের হাসি এমন এক নারী হোমায়রা আহমেদ। চড়াই-উতরাই যার জীবনের গল্পে রয়েছে নিখুঁত চিত্রায়ণে। অথচ চ্যালেঞ্জকে হাসিমুখে গ্রহণে সদা প্রস্তুত সেই মানুষটি। তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর গবেষণা সহযোগী হোমায়রা আহমেদ।
কিছু মানুষ পথ চলতে জানেন পথটি মসৃণ নয় জেনেই, কিছু মানুষ পথ চলতে পারেন পথে সমস্ত বাধাকে আলিঙ্গন করেই। যারা বাধাকে উপেক্ষা করে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন, সফল হন তারাই। হাসতে পারেন বিজয়ীর হাসি। হোমায়রা আহমেদের মুখে সর্বদাই সেই হাসি। হোমায়রার জীবন মুহূর্তে মুহূর্তে বাঁক বদলেছে, তিনি হাসতে হাসতে সেই বাঁকের পথে দাঁড়িয়ে সংগ্রামকে আলিঙ্গন করেছেন। জীবন শুরুর স্বপ্ন ছিল উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ। সেই উদ্দেশ্যে প্রবাসে পাড়ি জমালে ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতায় মাঝপথে থেমে যায়, কিন্তু সম্প্রতি আবারও নতুন করে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণে উদ্যমী হয়েছেন হোমায়রা। আবারও স্বপ্নজয়ে অদম্য প্রচেষ্টা।
জীবনের শুরুর পথটা বেশ মসৃণ ছিল হোমায়রার। শৈশব কেটেছে ঢাকাতে, বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের পিছনে ছিল বাসা। খুব দুরন্ত ও চঞ্চল ছিলেন তিনি। লিটল জুয়েলস স্কুলে পড়তেন। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠায় সবার আদরে আহ্লাদে খুব দারুণ শৈশব ছিল হোমায়রার। তবে পরবর্তী জীবনে চলার পথ ঠিক এতটাই মসৃণ ছিল তা নয়৷ নানা উত্থান-পতনে প্রতিবারই জীবনকে চিনেছেন নতুন করে। তবে সেই নতুনকেও বরণ করেছেন বিজয়ের মাল্যে।
শিক্ষাজীবনের শুরুটা বাড়ির কাছের ইংলিশ মাধ্যম স্কুলে হলেও মূলত তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। দুরন্ত হোমায়রা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নিয়ম-শৃঙখলায় কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলেন সেই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হোমায়রা বলেন, শৃঙ্খলার দুটি ধরন। একটি নিয়ম, আরেকটি বাধ্যবাধকতা। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ধরনটাই এমন যে স্কুল গ্রাউন্ডের ভিতরে নিয়ম মেনে তুমি স্বাধীনতা উপভোগ করো। যদি আপনি নিয়ম মানেন আপনার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। আমরা সেভাবেই স্বাধীনতা ভোগ করেছি, একইসাথে পরবর্তী জীবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। জুনিয়র সেকশনে থাকা পর্যন্ত খুব চাঞ্চল্য আর কথা বলা আমার বৈশিষ্ট্যে বর্তমান থাকলেও, সেভেনে সিনিয়র সেকশনে একটা শিক্ষণীয় বিষয় শিক্ষকের মাধ্যমে শিখি এবং আমার সামনে নতুন দুয়ার খুলে যায়। সেই শিক্ষাটা ছিল এমন, কাউকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করলে তুমি নিজে ছোটো হও না বা অন্য কেউও তাতে ছোটো হয় না, বরং বড়ো হও তুমি। আমূলে পালটে যায় আমার জীবন। ধীরস্থির হয়ে মনোযোগী হই পড়োশোনায়। একে একে স্কুল পাশ করে কলেজ, এরপর এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হই।
স্কুল ও কলেজজীবনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিল হোমায়রার সরব উপস্থিতি, একইসাথে পড়াশোনাতেও ভালো হওয়ায় তাকে শিক্ষকগণ চিনত এক নামে। কৃতিত্বের সাথেই এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে।
জীবনের এই জায়গাটাতে আছে খানিকটা টুইস্ট। বুয়েটে চান্স পেলেন, ভর্তিও হলেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কিছুটা টান অনুভবে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলত বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন, ছয় মাসের মতো ক্লাস করেন। এরপর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। এই জায়গাটায় হোমায়রাকে কিছুটা বেখেয়ালিই মনে হয়, তবে তিনি ঠিক সেভাবে ভাবতেও নারাজ। তিনি এও মনে করেন যে, তার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই ভুল ছিল না, যখন যেখানে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাই সঠিক। হয়তো কোনো বৃহত্তর স্বার্থেই জীবন মোড় বদলায়। যখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা যে উদ্দেশ্যে সেটা আমাকে ছাড়া হত না বলেই আমি মনে করি, বলেন হোমায়রা।
স্নাতক শেষ করার পর স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু হল না, এদিকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। স্কলারশিপ হল না, মাস্টার্সের ক্লাস শুরু আমি কিছুটা ভেঙে পড়ি, মাস্টার্সের রেজাল্ট অত ভালো হয়নি। কিন্তু আমি আমার বিভাগে প্রথম পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, কোনো মাস্টার্স লাগেনি, ডিরেক্ট স্কলারশিপ পাই। কুইন্স ইউনিভার্সিটি অফ বেলফাস্টে স্কুল অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে এনভায়রনমেন্টাল হেলথের উপর পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। সাথে ছিল আমার প্রিয় বন্ধু, পরে যার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হই। আমি বাংলাদেশকে ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য বেছে নিয়েছিলাম, ইচ্ছা ছিল ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করবো। কিন্তু এখানেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় হোমায়রার।
২০০৬ সালে বিআইডিএস এ যুক্ত হয়েছিলাম। আর পিএইচডির সে সময়টা ছিল ১/১১ এর সময়, গভর্মেন্ট কলব্যাক করছিল। এর মধ্যে আমার ডিভোর্স হয়। দেশে ফিরতে হয় আমাদের। ফিরে এসে জীবনকে জানতে হয় নতুন করে। সেসময়টা ডিভোর্স সচরাচর হত না, ফলে এটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না হোমায়রার স্বজনরা। সবচেয়ে সুখের স্মৃতি পরিণত হয় সবচেয়ে বড়ো যন্ত্রণায়। সামাজিকভাবে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যে ট্রমাটাইজড হয়ে যান হোমায়রা। উচ্চতর ডিগ্রির জন্য শিক্ষাগ্রহণের মানসিক অবস্থা হারান তিনি।
মানসিকভাবে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিতেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় আবার। বাবার ক্যানসার ধরে পড়ে। সেসময় হোমায়রার মনে হতে শুরু করে আর কখনোই উঠে দাঁড়ানো হবে না তার। ক্যানসার ধরা পড়ার পর আরো দুই বছর বেঁচে ছিলেন হোমায়রার বাবা। সেইসাথে মায়েরও কঠিন অসুখ ধরা পড়ে। পরিবারে হোমায়রাই বড়ো, ভাই ছোটো। ফলে, দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার কোনো পথই ছিল না তার। তার সামনে পথটি ছিল, শুধুই সামনে যেতে হবে। মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে অন্তত এইটুকু আশ্বস্ত করা যে তাদের আশা-ভরসার কন্যাটি ভালো আছে, সেই জন্য উঠে দাঁড়ান হোমায়রা।
হোমায়রা বলেন, যে সময়টায় বাবা অসুস্থ, পরবর্তীতে মা অসুস্থ সেই সময়ে আমি অনুভব করি জীবনের কঠিন এক সত্য। সেটি হল, মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও যদি পেশাদারিত্বের জায়গায় সে স্থির কোনো অবস্থানে না যায় তাহলে সে যেই হোক সমাজে তার পরিচয় সে একজন আশ্রিতা। যখন আমি দেখলাম আমার মায়ের অসুস্থতা, মায়ের চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে আমার কথা প্রাধান্য পাচ্ছে না, আমার মা যে কি না আমার অনুপ্রেরণা সেই মায়ের কাছেও আমি নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছি তখন আমি বুঝলাম আসলে উঠে দাঁড়াতে হবে। আমি যা আসলে সেটাই খুঁজে আনতে আমি আবার শুরু করেছি।
স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেই হোমায়রার কর্মজীবনের শুরু। শুরুটা হয়েছিল সিপিডিতে। এরপর একে একে কাজ করেছেন একশন এইড, ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবিতে। সবশেষে যুক্ত হন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। সেখানে প্রথমে জনসংখ্যা অধ্যয়ন বিভাগে যুক্ত হন এবং দীর্ঘসময় ধরে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
তবে, জীবনের চড়াই-উতরাই এই শেষ নয়, দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেখানেও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে হোমায়রা মুক্ত বিহঙ্গের মতো শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চান, বাঁচতে চান মানুষের মতো। তাই জীবনের কোনো বাঁকেই তিনি অন্যায়ের সাথে আপস করেননি, মাথা নত করেননি কোনো অসত্যের কাছে। যতবার হোঁচট খেয়েছেন ততবারই উঠে দাঁড়িয়েছেন নতুন প্রেরণা নিয়ে। নিজেকে তৈরি করেছেন, অকুতোভয় অপ্রতিরোধ্য গতি হিসেবে।
হোমায়রা বলেন, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী প্রজন্মকে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, অহংকারী হও। হ্যাঁ, অহংকারী হও তবে যোগ্যতা অর্জন করে। নিজের ভাষা, সংস্কার, সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য, ধর্ম, দেশ, জাতি সব কিছু নিয়ে যোগ্যতা অর্জন করে অহংকার করতে হবে, সেই সাথে থাকতে হবে আত্মসম্মানবোধ, আর তাহলেই একটা মানুষকে পৃথিবীর কোথাওই আটকাতে হয় না।
জীবনের গল্প কেউ লুকায়, কেউ মুছে ফেলে, কেউ শুরু করে সাতপাঁচ না ভেবেই। হোমায়রা জীবনকে এক গভীর অনুভূতিতে ধারণ করেন যেখানে বাস্তবতার কষাঘাত থাকলেও আছে শরৎ মেঘের মতো স্বপ্নের বিচ্ছুরণ। গবেষণাপত্রে যুক্ত হবার পাশাপাশি হোমায়রার নামটি এখন জায়গা করে নিচ্ছে সাহিত্যের অঙ্গনে। তার লেখনিতে এখন কাব্য, হোমায়রার বই বেরিয়েছে কবিতার। সেইসাথে আবৃত্তির অঙ্গনে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেছেন, যুক্ত আছেন আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনের সাথে। চড়াই-উতরাইয়ের সমস্ত পথ অতিক্রম করে এসে স্বপ্নরা আবারও ডানা মেলেছে আকাশে। গবেষণাকাজের পাশাপাশি হোমায়রা আবারও মনোনিবেশ করেছেন উচ্চতর শিক্ষায়। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য শীঘ্রই বিদেশে পাড়ি জমাবেন, অসমাপ্ত স্বপ্নকে এবার পূরণ করার পালা।
বিবার্তা/এসবি/সউদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]