শিরোনাম
মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ডা. ফেরদৌস খন্দকার
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩, ১৪:২৫
মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ডা. ফেরদৌস খন্দকার
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

“তুমি যদি তোমার কাজকে স্যালুট করো, তাহলে তোমার আর কাউকে স্যালুট করতে হবে না । কিন্তু যদি তুমি তোমার কাজকে অসম্মান করো, ফাঁকি দাও কিংবা অমর্যাদা করো, তাহলে তোমারই সবাইকে স্যালুট করে যেতে হবে।" কথাটি এ. পি. জে আবদুল কালামের।


কাজকে স্যালুট করে নিজেই স্যালুট পান এমন বিশেষ একজন ডা. ফেরদৌস খন্দকার। একজন চিকিৎসক হিসেবে যিনি দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চিকিৎসার সেবাদানকে করেছেন জীবনের মহান ব্রত। তবে চিকিৎসাসেবাই তার জীবনের একমাত্র ব্রত নয়—


মানুষের কল্যাণে, সেবায় ও মঙ্গলের যেকোনো প্রয়োজনে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য অকাতরে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার। উল্লেখ্য, শত ব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্যের বীণাটি তার হাতে বাজে। লিখেছেন ইতিহাসমৃদ্ধ বই 'আওয়ার বাংলাদেশ'।



আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত হতে কেন উদ্বুদ্ধ হলেন জানতে চাইলে ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেন, ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পর চলে যাই যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু মন পড়ে থাকে দেশে। সেসময় মনে ভাবনার উদয় হয়— বাংলাদেশের মাটি, হাওয়া, খাদ্য সব ব্যবহার করে আমি বড় হয়েছি, তৈরি হয়েছি। অথচ দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ আমার হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের সেবা হয়নি আমার, ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করে।


এরপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম যেদিন বেতন পাই, ছত্রিশশো ডলার, সেটা থেকে ১০০ ডলার দেশে পাঠাই। ইনকামের ছোট অংশ দিয়েই শুরু করি। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভিটামিন পাঠাই, এভাবেই শুরু। আসলে দায়িত্ববোধ থেকেই শুরু করা। সেই শুরু, আর থামিনি।


ডা. ফেরদৌস খন্দকারের গল্প বলার আগে ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে। কোভিড-১৯ আঘাত হানল পৃথিবী জুড়ে। সারা পৃথিবীর মতোই করোনাভাইরাসের কালো থাবায় দিশেহারা যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর ও আক্রান্তের মিছিল। সেসময় সামনে চলে আসেন নিউ ইয়র্কে করোনাযুদ্ধের অসামান্য এক নায়ক। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর নায়ক ডা. ফেরদৌস খন্দকার। কোভিড-১৯ মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসন হাইটসে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন ডা. ফেরদৌস।



একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে যে বাংলাদেশিরা আছেন, তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় আশা ও ভরসার প্রতীক ম্যানহাটনের প্রাচীনতম মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।


ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকারের বাবা ফয়েজ আহমেদ খন্দকার। তিনি বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। মা আনোয়ারা বেগম খন্দকার। একজন গৃহিনী। ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকারের দুই বোন। একজন ফারাহ জেবা খন্দকার, ফ্লোরিডা প্রবাসী ফার্মাসিস্ট। তার স্বামী ডা. তানজীম। ডা. ফেরদৌসের অপর বোন চাঁদনী একজন ফ্যাশন ডিজাইনার।


বর্তমানে দেশ ও দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের কাছে দারুণ এক নাম ডা. ফেরদৌস খন্দকার। আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি এই চিকিৎসক করোনাকালে ফ্রন্ট লাইনারের অবস্থানে থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছেন মানুষের।


ডা. ফেরদৌস জানান, যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্টসিনাই কুইন্স হসপিটাল এবং প্রেসবাইটেরিয়ান কুইন্স হসপিটালে চিকিৎসক হিসেবে তিনি 'অ্যাফিলিয়েটেড'। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তার তিনটি ক্লিনিক আছে, সাতজন ডাক্তার তার সাথে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ডা. ফেরদৌস খন্দকার। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শেখ রাসেল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তিনি।


নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফেরদৌস খন্দকার। নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করলে অনেক চিকিৎসক চেম্বার বন্ধ রাখেন। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন ডা. ফেরদৌস। দুঃসময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. ফেরদৌস। চেম্বার খোলা রেখে করোনা আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। মনস্থির করলেন নিজের মাতৃভূমিতে এসে নিজেকে বিলিয়ে দিবেন দেশের মানুষের স্বার্থে।



ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেন, আসলে— মানবসেবা একটি রোগ, একবার পেয়ে বসলে সারানোর কোনো ওষুধ নাই। সেখান থেকেই একটি হাসপাতাল, কারিগরি শিক্ষার স্কুল এন্ড কলেজ করেছি। কেনিয়াতে একটি স্কুলে পানির সাপ্লাই দেওয়া হয় আমার তত্ত্বাবধায়নে। নেপালে একটি আশ্রম আছে নাম 'মায়াঘর' কাজ— অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করা, সেখানে রয়েছে ৩৫ জন শিশু । ভারতে কলকাতার সুন্দরবন অংশে একটি আশ্রমের সাথে আছি। রংপুরে নারী ক্রিকেট একাডেমিতে কনটিনিউ সাপোর্টার আমি।


বিদেশে কী করছি, তারচেয়েও বড়ো যে বিষয়টি আমার কাছে তা হলো- আমার নিজ এলাকা কুমিল্লার দেবিদ্বারে যখনই যে মানুষটি বিপন্ন হয়, আমি পাশে দাঁড়াই।


অতি সম্প্রতি, কুমিল্লার দেবিদ্বারে শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ’র উদ্যোগে সাড়ে ৬শত বীর মুক্তিযোদ্ধার মাঝে স্থায়ী স্বাস্থ্য সেবা কার্ড বিতরণ করা হয়। ফেরদৌস খন্দকার কারিগরি স্কুল অডিটরিয়ামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এই স্বাস্থ্য সেবা কার্ড বিতরণের কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ৯ মে ২০২৩, কুমিল্লার দেবীদ্বারে শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ’র উদ্যোগে সাড়ে ৩শত মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা কার্ড বিতরণ করা হয়।



করোনা মোকাবিলায় দেবিদ্বারের বিভিন্ন এলাকার অসহায় ও দুস্থ বিধবা নারীদের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছেন ডা. ফেরদৌস খন্দকার। ২০২১ সালে নিউইর্য়কের শেখ রাসেল ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. ফেরদৌস খন্দকারের আর্থিক সহযোগিতায় দেবিদ্বার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৮২জন বিধবা ও বিপদগ্রস্থ মহিলাকে খাদ্য সহায়তা ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়।


ডা. ফেরদৌস খন্দকার জানান, যেখানে মানবতা বিপন্ন, যেখানে মানুষের একটু সাহায্যে আমি পিছপা হইনি। মাটির মানুষ, মানুষের মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে যেতে কে না চায় উচ্চ ডিগ্রির পিছনে জন্য, কিন্তু আমি চেয়েছি সেভাবে না গিয়ে মাটির কাছের মানুষ তাদের সেবাতে আমি নিয়োজিত হব। সবসময়ই বাংলাদেশিদের গন্ধ শুঁকতে চেয়েছি, তাদের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি, তাদের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছি। ভালোবেসে মানুষের জন্য করি, ভালোবাসা পাইও। দেশের মানুষ যেমন আমাকে ভালোবাসে, তেমনি প্রবাসীরা আমাকে ভালোবাসে।



ছোটবেলা থেকেই স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতে পছন্দ করতেন ডাক্তার ফেরদৌস। গ্রামে এবং নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজের সাথে জড়িত ছিলেন এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ইন্টার্নিশিপসহ মেডিসিনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তারপর পরিবারসহ পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার নিউইয়র্ক মেডিকেল কলেজ থেকে প্রশিক্ষণসহ চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ডাক্তার ফেরদৌস। পাশাপাশি জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ডাক্তার ফেরদৌস কোন কাজকেই ছোট মনে করেননি। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিজের পরিশ্রম আর অধ্যবসায়কে বেছে নিয়েছেন ডাক্তার ফেরদৌস। নিজের পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ডাক্তার ফেরদৌস হয়ে উঠলেন সফলদের একজন।


কেন নিজ গ্রামে কারিগরি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, গ্রাম পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের গাইড লাইন ও কমর্মুখী শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় ভবিষ্যৎ কর্মমুখী পরিকল্পনা নিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ কম পাচ্ছে। মূলত গ্রাম পর্যায়ে কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে বেকারত্ব হার হ্রাস করার জন্য আমার মা ও আমি এই কারিগরি স্কুলটি প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছি। এতে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।


শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ’র কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. ফেরদৌস খন্দকার বলেন, “দেশে বেড়ে ওঠা শিশু কিশোরদের পাশাপাশি যারা প্রবাসে বড় হচ্ছে তাদের কথাও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে তারা বাংলা ভাষা কতটা শিখতে পারছে, সেটা প্রতি নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি সমন্বিত একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে”।



ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, একটা সময় আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলাম। পরে ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সময়ে বাবা আমাকে খুব বকলেন, আর এ বিষয়টি আমাকে পরিবর্তন করে দিলো। মাত্র তিন মাস পড়াশোনা করে আমি ফার্স্ট বয় হয়ে গেলাম। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৮ সালে যখন এদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিদেশ চলে গেলেও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আমি সবসময় ধরে রেখেছি। সবাই বড় ডাক্তার হতে চাইলেও আমি ছোট বেলা থেকে ছোট ডাক্তার হতে চাইতাম। কারণ, সাধারণ মানুষকে ছুঁয়ে দেখা আমার স্বপ্ন ছিল। বাংলাদেশিদের সেবা করবো, এই চিন্তাভাবনা সবসময়ই আমার মাঝে ছিল। আমি পশ্চিমা বিশ্বে ৩০ বছর কাটিয়েছি, কাজেই কিভাবে জনসেবায় পরিবর্তন আনতে হয়, সেটা আমি জানি।


শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন (ইউএসএ) ইনক'র সভাপতি মানবিক মানুষ ডা. ফেরদৌস খন্দকার, তার মূল লক্ষ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে দেওয়া এবং স্কুল কলেজ এর ছাত্র, ছাত্রীদের মাঝে তার মূল্যায়ন গড়ে তোলা। তিনি বলেন, দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত- একটি পক্ষ স্বাধীনতার পক্ষে আর একটি স্বাধীনতা বিরোধী, তাই এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশ, জন্মভূমি এবং স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে নাকি ভুল সিদ্ধান্ত নিবে।


ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখার পাশাপাশি, ফেসবুক এবং ইউটিউবে নিয়মিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন করাই তার অন্যতম লক্ষ্য।


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়া অবস্থায় ডা. ফেরদৌস খন্দকার ছিলেন রাজপথে অনেক মিছিল মিটিংয়ের কণ্ঠস্বর। সেই স্বর এখন মানবকল্যাণে সোচ্চার, নিবেদিত। সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২০ সালে ইউনেস্কো ক্লাব সম্মাননা পেয়েছেন ডা. ফেরদৌস খন্দকার।


বিবার্তা/এসবি/মাসুম

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com