স্বপ্নজয়ের সারথি ঢাবি শিক্ষক রহিমা আক্তার
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:০৯
স্বপ্নজয়ের সারথি ঢাবি শিক্ষক রহিমা আক্তার
সামিনা বিপাশা ও সাইদুল কাদের
প্রিন্ট অ-অ+

'আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে একটা মেয়ে হিসেবে এভাবে অপেক্ষা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল।  কিন্তু প্রথম থেকে এটিই আমার স্বপ্ন ; এই লক্ষ্য থেকে আমি একদিনের জন্যও বিচ্যুত হইনি।  স্বপ্নতো পূরণ করতেই হবে তাই অন্য পেশায় ও আগ্রহ ছিল না। শিক্ষকতাকে আমি কখনো একটি চাকরি হিসেবে বিবেচনা করিনি, এটি ছিল আমার স্বপ্ন, সাধনা। আমি সব সময় ভাবতাম শিক্ষক আমাকে হতেই হবে। বেতন পাবো আর চাকরি করবোএটা আমার ভাবনায় ছিল না। তাহলে হয়তো অন্যকিছু করার কথাই ভাবতাম।' নিজের সাফল্য সম্পর্কে দৃঢ়কণ্ঠে এভাবেই বলছিলেন রহিমা আক্তার মুক্তা। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক  রহিমা আক্তার মুক্তা। তিনি ২০১৭ সালে ৫০ তম সমাবর্তনে খালেদা মঞ্জুরী খুদা গোল্ড মেডেল অর্জন করেন এবং ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সর্বোচ্চ ফলাফলের স্বীকৃতি স্বরূপ ডিনস্ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি  রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে  দয়িত্ব পালন করছেন। 



আব্দুস সালাম হাওলাদার ও হোসনেআরা বেগম দম্পতির সন্তান রহিমা আক্তার মুক্তা। বাবা আব্দুস সালাম হাওলাদার কর্মজীবনে প্রথমে বেসরকারি চাকরি করতেন এবং পরবর্তীতে মেডিসিন ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। মা গৃহিণী। তারা চার ভাইবোন। বড় ভাই জনতা ব্যাংক লিমিটেডে , মেজ ভাই  বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার  প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে  এবং ছোটবোন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন ।


 মুক্তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনা শহরে ।সেখানেই স্কুলজীবন শুরু। বাবার বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদে এরপর ঢাকায় ছয়মাসের মতো পড়ালেখা চলে৷ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় আবার খুলনায় চলে আসা এবং সেখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা। বাগেরহাট থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাশ করে খুলনায় ফিরে যান এবং সেখানে খুলনা সরকারি পাইওনিয়ার মহিলা কলেজ থেকে ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন সবগুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। কিন্তু চোখে একটাই স্বপ্ন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে। শুরু হয়  সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনের অধ্যবসায়।



মুক্তা বলেন, প্রথম বর্ষ থেকেই লক্ষ্য ঠিক করে ফেলি ভালো রেজাল্ট করার। সে অনুযায়ী পড়ালেখা শুরু করি৷ ফলস্বরূপ  বি.এ(সম্মান) এবং  এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা এবং ক্লাস করার ক্ষেত্রে খুবই ধারাবাহিক ছিলাম। অনার্স জীবনে একটা ক্লাসও মিস করিনি। এমনকি অসুস্থতাজনিত কারণেও ক্লাস মিস হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধু মাস্টার্সের শেষ ক্লাসটা মিস করি আমি৷


আমি খুব ধৈর্যশীল ছিলাম, জীবনে শিক্ষকই হবো এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যদিও পারিবারিক ও সামাজিক চাপ ছিল বিসিএস দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি নিজের লক্ষ্য থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। বিভাগে ২০১৭ সালে শিক্ষক নিয়োগ  সার্কুলার হয়। আমি ভেবেছিলাম আমার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু ডাবল ফার্স্ট হওয়া সত্ত্বেও আমার  হয়নি। না হওয়াতে এক দুই বছর খুব হতাশায় কেটেছে। তবে আমি বিশ্বাস হারাইনি। আমার শিক্ষকরাও অনেক সাহস যুগিয়েছেন। এছাড়াও বিশেষ কিছু মানুষ নেপথ্যে  আছেন  যারা আমাকে সবসময় উৎসাহ অনুপ্রেরণা ভলোবাসা দিয়ে গেছেন এই দীর্ঘ পথ চলায়।  আমি হতশায় ভুগিনি কখনো যদি ও একটা পর্যায়ে অনেকেই আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। 


২০২০ সালে আবার আমার ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক  নিয়োগের সার্কুলার হয়।  তখন এপ্লাই করার পর দুর্ভাগ্যবশত ঐ সার্কুলার ২০২১ সালে বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০২২ সালে নতুন করে আবার সার্কুলার দেয়। আমি আবেদন করি। ১৫ নভেম্বর,২০২২ সালে আমার ভাইভা হয়। ১ ডিসেম্বর, ২০২২ সালে অবশেষে বিভাগে প্রভাষক  হিসেবে যোগাদান করি। দীর্ঘ  অপেক্ষার পর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম সোপান দৃশ্যমান হয়।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে থাকতেন মুক্তা। ৪০৬ নম্বর রুমে। হলে থাকাটা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। হলে আসার আগপর্যন্ত পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় এবং আদুরে ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একদম বিপরীত জীবন। সবকিছু করতে হয় নিজে নিজে। 


মুক্তা পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুল কলেজ  পর্যায় থেকে ডিবেট করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হলে থাকাকালীন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন।  প্রথম বর্ষ থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে ও সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 


নিজ বিভাগে নিজেরই শিক্ষকদের  সাথে কাজ করার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে মুক্তা বলেন,এটা খুবই গর্বের এবং সম্মানেরও।  বর্তমানে যারা ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করছেন তাদের বেশীরভাগই  আমার সরাসরি শিক্ষক।  এতে করে আমার এখনও মনে হয় আমি ছাত্রীই আছি। শিক্ষকরা সকলে আমাকে খুব আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করেন। এই অনুভূতিটা অন্যরকম। যেই আমি ছাত্রী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি সেই আমি আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেছি।


রহিমা আক্তার মুক্তার জীবনের আদর্শ তার বাবা-মা। অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে তারাই অনুসরণীয়  যারা সফল।  যোগ্য ও সফলদের কাছ  যাকে যেখানে যেভাবে পেতেন সেভাবে অনুপ্রেরণা নিতেন৷ যেকোনো ঘটনা থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। তিনি মনে করেন, ছোট বড় সব ঘটনাই জীবনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা নিয়ে আসে। তবুও, বন্ধুমহল ও পরিবার অনুপ্রেরণা পেয়ে তিনি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ক্ষেত্রে তার ছোট  ভাইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। 


কখনও মেয়ে হিসেবে সমাজের প্রতিবন্ধকতার শিকার হননি।পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছেন সবসময়।  তবে যখন অনেকটা সময় ধরে স্বপ্নপূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তখন একরকম প্রতিবন্ধকতা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ  করে বেকার থাকা, বিয়ে না করা সবকিছু মিলিয়ে সময়টা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। একদিকে পরিবারের প্রত্যাশা  অন্যদিকে সামাজিক চাপ। অপেক্ষা যখন অতিমাত্রায় চলে যাচ্ছিল সব অর্জন কেমন জানি ফ্যাকাসে লাগছিল। 


রহিমা আক্তার মুক্তা উচ্চতর শিক্ষার অংশ হিসেবে ২০২০ সালে এমফিল শেষ করেন। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার ওপরে এমফিল করেছেন। আরো উচ্চতর শিক্ষালাভের আশায় করতে চান পিএইচডি। জীবনের পরবর্তী স্বপ্ন ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করা৷ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কুসংস্কার মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণেকাজ করতে চান।


রহিমা আক্তার মুক্তার লক্ষ্য  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে যে জায়গায় কাজ করতে হয় সেখানে কাজ করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  আমাদের শিখিয়েছে সকল ধর্ম সমান,সব মানুষ সমান। বিশেষ করে আমাদের স্কুল কলেজগুলোতে এ চর্চাটা  একেবারে কম হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় শিক্ষা দেয় ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমার ইচ্ছে, স্কুল কলেজ সকল স্তরে  ধর্ম শিক্ষার সাথে সাথে বিশ্ব ধর্ম অথবা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়টা পড়ানো হোক যা হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার মূল ভিত্তি। কোনো ধর্মের মাঝে যেন বিভাজন না থাকে। কোনো মানুষের মাঝে যেন বিভেদ না হয়। ছোটবেলা থেকে যদি আমরা শিক্ষার্থীদের এই জিনিসটা শিখাতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ বিশৃঙ্খলা,অধঃপতন, কুসংস্কার থেকে অনেকটা রেহাই পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেই ছোটবেলার শেখানো বুলির ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগে যায়। মানুষের মাঝে যখন ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা কাজ করবে তখন এই ধর্মীয় বিভেদ অনেকাংশে কমে যাবে। আর এই সহমর্মিতা শুধু ধর্ম নয় ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে থাকা উচিৎ তবেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। 


আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে দেরিতে হলেও। জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসেব টা খুব বেশি করি না তাই  অপ্রাপ্তির জায়গাটাও কম। একটি কথা আমি  মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, পরিশ্রম এবং সততা এই দুয়ের সমন্বয় থাকলে সফলতা আসবেই আজ অথবা কাল।তাই লক্ষ্য অর্জনে পরিশ্রমের পাশাপাশি সৎ থাকাটা খুবই জরুরি।


বিবার্তা/সাইদুল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com