শিরোনাম
‘আমড়া বন্ধনে’ বিশ্ব ছোঁয়ার সম্ভাবনা
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:০০
‘আমড়া বন্ধনে’ বিশ্ব ছোঁয়ার সম্ভাবনা
মোঃ আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি
প্রিন্ট অ-অ+

পেয়ারা বন্ধনে আবদ্ধ বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি। প্রশাসনিকভাবে তিনটি জেলা। ভৌগলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থানের দক্ষিণের এই তিন জনপদ পেয়ারা উৎপাদনে ও গুণে-মানে-স্বাদে খ্যাতির বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। সঙ্গে বাগান ও তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খাল পেরুনোর মনোরম সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি তো রয়েছেই।


স্থানীয়রা বলছেন, এবার ‘আমড়া বন্ধনে’ হারিয়ে যাওয়ার গল্প। স্বপ্ন দেখছেন বিশ্ব ছোঁয়ার। এ সম্ভাবনাও নেহায়েত কম নয়।


ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলীর আমড়াচাষী রিপন চৌধুরী (৫৭)। তার পাশে নৌকা নিয়ে ভাসছিলেন মলয় হালদার। এসব বিষয়ে তিন নৌকার পাটাতনে বসে বিস্তার কথা হয়। পেয়ারার রাজ্যে তারা আমড়া বিপ্লবের কথা শোনান।


রিপন চৌধুরী ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়েছেন এ বছর। আষাঢ়ের শুরুতে যখন ফল ধরার আগ মুহূর্ত তখন কায়দা করে জমির একাংশ নেন ২৫ হাজার টাকায়। কেমন লাভ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জমিতে ৫০ মণের ওপরে আমড়া ধরবে। ইতোমধ্যে ১০-১৫ মণ বিক্রিও করেছি। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি, আমড়ার ভরা মৌসুম। তাই দামও ভালো হবে। এবার ব্যবসায়ীরা কেবলই আমড়া নেবেন।


তবে আফসোস করে বলেন, কুড়িয়ানা, আটঘর, ভীমরুলী কিংবা ডুমুরিয়া, বেতরা- যেখানেই বলি না কেন বিপুল উৎপাদিত আমড়া সংগ্রহে এসব এলাকার ব্যবসায়ী-আড়তদার পর্যাপ্ত নয়। তবুও হাল ছাড়েন না, আশা হারান না।


বলে উঠলেন, জলে ভাসা হাটে পেয়ারা যেমন বিক্রি হয় তেমনি আমড়াও হয়। চলে যায় দেশব্যাপী। শুধু তাই নয়, এখানকার আমড়া মরুভূমির বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে বড় বড় জাহাজে।


রিপন জানান, তৃণমূলে অর্থাৎ বাগান থেকে সংগ্রহ করা আমড়া প্রথম দিকে ৩শ’-সাড়ে ৩শ’ টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এখন তা সাড়ে ৪শ’ থেকে ৮শ’র কাছাকাছি। আমড়া পেয়ারার মতো অতিদ্রুত পচনশীল নয়, বিধায় এটি চাষে নূন্যতম লাভ হয়।


নৌকা বেয়ে ভীমরুলী ভাসমান হাটে যাচ্ছিলেন মলয় হালদার। দু’পক্ষের কথা শুনে থমকে দাঁড়ান তিনি। পেয়ারা শেষ, নৌকায় কেবল আমড়া আর আমড়া। হাটের খানিক আগে, একটু বাঁয়েই তার বাগান। মনোরম সুন্দর পরিবেশ আর পাখির কলকলানির মধ্যে সাত সকালে আমড়াগুলো পেড়েছেন বলে জানান মলয়।


একেবারেই তাজা। ছাল ছিলে খন্ড আকারে কাটতেই রস পড়বে চুইয়ে- এমনটাও বললেন তিনি। বিক্রি করবেন হাটে, তা চলে যাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে।


তিনি জানান, গুণ-মান ভালো দেখেই এখানকার আমড়ার চাহিদা আছে। যারা আমড়া কেনেন সবাই চান এই অঞ্চলেরই কিনতে। খাঁটি জিনিসের মূল্যায়নই আলাদা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আরো সহযোগিতা করার ওপর জোর দেন মলয়।


এদিকে ভীমরুলীতে বাগান পরিদর্শনে উঠে এলো চাষীদের কিছু সমস্যার কথাও। বর্ষা মৌসুমে এক ধরনের লেদাপোকা গাছের পাতা খেয়ে, পাতাশূন্য করে ফেলে। এতে আমড়া চাষে ক্ষতি হয়। এ জন্য কৃষক-চাষী-বাগানিরা চান স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তা। কিন্তু সাড়া পান না তেমন। তারা কীটনাশকমুক্ত আমড়া চাষাবাদে আগ্রহী।


জানালেন, পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া এই আমড়া চাষ হোক কোনো প্রকার ওষুধ ও বিষমুক্ত পদ্ধতিতে। তাই তো স্বাদ এতো বেশি। কদর এতো।


ভীমরুলীতে আড়ত ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি। সবাই মূলত পেয়ারা কেনেন। তবে পেয়ারার শেষ সময়ে শুরু হয় আমড়ার ভরা মৌসুম। সে জন্য আড়তদাররা থেকে যান আগের মতোই। চলে আমড়া বিকিকিনির হাঁকডাক। ডুমুরিয়া, বেতলা, ডালুহারসহ ঝালকাঠির বেশির ভাগ গ্রাম পেয়ারার পাশাপাশি আমড়া চাষের জন্যও বিখ্যাত।


বর্তমানে আমড়া বিক্রি হচ্ছে আটঘর, পিরোজপুরের কুরিয়ানাসহ ঝালকাঠির ভীমরুলী পানিতে ভাসমান বাজারে। তবে সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার ভীমরুলী। এখানকার জৌলুসই আলাদা। সকাল ৮টার মধ্যে বাজার বসে, বেচাকেনা চলে দুপুর পর্যন্ত।


এছাড়া ঝালকাঠি হয়ে জলপথে কিংবা সড়ক পথে সোজা বরিশাল অথবা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি দিয়ে গরিয়ারপাড় থেকে বরিশাল সদরে প্রবেশ করছে এসব অঞ্চলের সুস্বাদু ফল আমড়া। যা পরে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন বড় শহরে।


এদিকে বরিশালের সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, কাউখালী এবং ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর ও নলছিটিতে আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। এসব অঞ্চলের দেড় হাজার একরেরও বেশি জমিতে সরাসরি আমড়া চাষ হচ্ছে। স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানাতেও আমড়া বিক্রির জন্য রয়েছে ভাসমান হাট।


ছোট ডিঙিতে বা নৌকায় করে চাষী-বাগানিরা আসেন এখানে। আর ট্রলারে করে আড়তদাররা তা কিনে নেন। সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে গেছে খাল। খালের নাম স্থানের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার খেয়াঘাট পেরিয়ে মাহমুদকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর, ধলহার, ব্রাহ্মণকাঠি, আদমকাঠি এরপর পাশের জেলা ঝালকাঠি। তার দুই-এক কিলোমিটার পরেই ভীমরুলীতে প্রবেশ। এসবই ভাসমান হাট। পুরো আশ্বিন জুড়েই আমড়া বিক্রিতে এসব হাট জমজমাট থাকবে। তবে পেয়ারার মতো এতোটা গমগমে হবে না, তাও বা কম কী।


ভীমরুলীর আড়তদার লিটন হালদার, কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, শ্রাবণ মাস শেষ হলেই আমড়ার ভরা মৌসুম। এ সময় যত আমড়া এই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়, এমনটা সারা বাংলাদেশে আর কোথাও হয় না। দেশব্যাপী দক্ষিণের আমড়ার সুনাম রয়েছে। বিশ্বজুড়ে খ্যাতিও।


তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মণ আমড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর পাঠাচ্ছেন। বস্তা হিসেবে আমড়া যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। বস্তা প্রতি আড়াই মণ। দাম ৭শ’ থেকে ৮শ’র মধ্যে। আশ্বিনের শেষভাগে যখন আমড়া শেষের দিকে থাকবে তখন এই দাম আরো বাড়বে।


চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে কাঁচা আমড়া ও প্রক্রিয়াজাত আমড়া বিভিন্ন দেশে যায়। তবে খুব কম। এছাড়া লন্ডনেও গত বছর থেকে এ অঞ্চলের আমড়া রফতানি হচ্ছে। যা আরো ব্যাপক আকারে উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মত দেন আড়তদার লিটন।


আরেক আড়তদার আবদুর রহিম বেপারী জানান, তিনি স্বরূপকাঠি দিয়ে লঞ্চে আমড়া পাঠান। সরাসরি তা ঢাকার লালকুঠি-শ্যামবাজারে পৌঁছে। চাহিদা ভালো, সেখানে ৪নং ঘরের, আরব আলী তার বেশ কয়েকদিনের চালান অগ্রিম কিনে রেখেছেন। এদিন সাড়ে ৬শ’ দরে ৩১ মণ আমড়া পাঠান ঢাকায়। আর কয়েকদিন পর চট্টগ্রামেও যাবে তার আমড়া।


পাঠানোর খরচ বিষয়ে আবদুর রহিম বলেন, এক বস্তায় দুই মণ আমড়া পাঠাতে খরচ ৫০০ টাকা। সরকার থেকে যদি সরাসরি আমড়া কিনতো অথবা বড় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সরাসরি নিয়ে যেতেন তবে এর প্রচার-প্রসার আরো বাড়তো। বিদেশে রফতানির পরিমাণও বৃদ্ধি পেতো।


কীর্তিপাশা থেকে শামীম আমড়া নিয়ে এসেছেন ভীমরুলী হাটে। রোজই আসেন। দৈনিক তার সরবরাহ দুই থেকে চার মণ। দাম চান সাড়ে ৮শ’ করে। মোঃ ইয়াসীন (২০) চাষী নন। বাগান থেকে সরাসরি আমড়া কিনে বিক্রি করতে এনেছেন হাটে। ১০ থেকে ১১ মণ হবে তার নৌকায়।


ইয়াসীন জানালেন, ঝালকাঠির রাজাপুর থেকে প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার বস্তা আমড়া জেলা শহর, ভান্ডারিয়া কিংবা কাউখালী হয়ে লঞ্চযোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সুমদ্রবন্দর দিয়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেও এই দক্ষিণের আমড়া রফতানি হচ্ছে কয়েক বছর হলো, শুনেছেন তিনি।


আমড়া সংরক্ষণ করা যায় সহজে। দ্রুত পচে না, কাঁচা লবণ-মরিচ দিয়ে খাওয়া যায়, ঝাল-টক-মিষ্টি আচার বানানো যায়, চাটনি তৈরিসহ মোরব্বা তৈরিতেও আমড়ার বিকল্প কমই। তাই এর চাহিদা প্রচুর বলে জানালেন, স্থানীয় চাষী-বাগানি এবং ব্যবসায়ী-আড়তদাররা।


সরকারের খানিক উদ্যোগ ও গুরুত্বই পারে এসব এলাকার আমড়ায় সম্ভাবনার দ্বার আরো উন্মোচিত করতে। এতে অর্জিত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা। সার্বিকভাবে সারাবিশ্ব ছোঁয়ার প্রতিশ্রুতি খেটে খাওয়া এই কৃষকদের।


বিবার্তা/আমিনুল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com