শিরোনাম
জুম চাষীদের আগুনে পুড়ছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৪৭
জুম চাষীদের আগুনে পুড়ছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ
তৌহিদ সোহান/নুরুল করিম আরমান, লামা
প্রিন্ট অ-অ+

বান্দরবানের লামা উপজেলার পাহাড়ে পাহাড়ে এখন জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জুম চাষীরা। ইতোমধ্যে পাহাড় বাছাই এবং বাছাইকৃত পাহাড়গুলোর গাছপালা, গুল্ম ও লতাপাতা কেটে ফেলে এখন সেসব জঞ্জাল আগুনে পোড়ানো হচ্ছে।


বিগত ১৫-২০ দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ আগুনে পুড়েছে অর্ধশতাধিক পাহাড়। সে অগ্নিকাণ্ডে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আকাশ। আর আগুনের কুণ্ডলীতে মেঘাচ্ছন্ন ও উত্তপ্ত বাতাস প্রবাহিত হয়। প্রচন্ড দাবদাহে নদী, খাল বিল ও ঝিরির পানি পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম।


এদিকে এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি পেটের পীড়াসহ ডায়রিয়া, আমাশয় ও বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিও ছড়িয়ে পড়ছে এলাকার লোকজনের মাঝে। আগুনে পুড়ে মাটি সাময়িক উর্বর হলেও সবুজ বন পুড়ে ছাই হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের মাটি ধসে খাল, বিল, নদী নালা ভরাট হয়ে যায়।


পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তাদের জীবন-জীবিকা এখনো প্রায় জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ অতি সামান্য বিধায় বাধ্য হয়ে জুম চাষীরা সনাতন পদ্ধতিতে জুম চাষ করেন। জুমে ধান, ভুট্টা, পেঁপে, কলা, আনারস, মারফা, চিনার, মরিচ, তুলা, আলু (সাদা আলু), কাসাভাসহ (শিমুল আলু) নানা ফসল রোপন করা হয়।


বিকল্প কোনো চাষের উদ্ভব এখনো না হওয়ায় প্রতিবছর জুম চাষীদের জঞ্জাল পোড়ানোর আগুনে প্রত্যন্ত পাহাড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ সবুজ বনভূমি পুড়ে ন্যড়া পাহাড়ে পরিণত হয়। মাটি শুকিয়ে বর্ষা মৌসুমে ধসে পড়ে পাহাড়। ক্ষয় হয়ে যাওয়া মাটি পড়ে ভরাট হয় ঝিরি, খাল, বিল ও নদী। আর এ কারণে বর্ষা মৌসুমের সামান্য বৃষ্টিপাতে নিম্মাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। বিলুপ্ত হয় পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। ভারসাম্য হারায় পরিবেশ।


এদিকে কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, জুমের বিকল্প চাষে উৎসাহিত করার কারণে সনাতন জুম প্রথা থেকে সরে আসছে জুম চাষীরা।


উপজেলার গজালিয়ার জুম চাষী অংহ্লাপ্রু মার্মা বলেন, এক পাহাড়ে পর পর দু’বার জুম করা হয় না। কারণ এক পাহাড়ে বার বার ফসল ভালো হয় না। তাই একেক বছর একেক পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। এখন পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে গাছপালা, গুল্ম ও লতাপাতা পোড়ানো হচ্ছে। এরপর সামান্য বৃষ্টি হলেই ফসল রোপণ শুরু হবে।


তিনি আরো বলেন, এখনো এ চাষের বিকল্প কোনো চাষের ব্যবস্থা না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে এ চাষ করছি।


চলতি মৌসুমে সরকারি হিসেবমতে এবার জেলায় ১৫-২০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি ভূমিতে জুম চাষ করা হবে বলে জানা গেলেও বেসরকারিভাবে এর পরিমাণ বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।


অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, পার্বত্য তিন জেলায় জুম চাষের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কাজ করেছে সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএফএসডি) নামের এক প্রতিষ্ঠান।


তাদের মতে, প্রথাগত চাষ পদ্ধতি হিসেবে জুম চাষ কয়েকশ’ বছর ধরে চলে এলেও এই চাষ পদ্ধতি পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তবে জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পাহাড় থাকলে জুম চাষের সময়ের আবর্তনটা সঠিকভাবে রক্ষা করা সম্ভব। আর এ সময় আবর্তনটা ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ধরে রাখা গেলে যেটুকু বিরূপ প্রভাব ফেলে তা প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। এখন যে হারে জুম চাষ হচ্ছে তাতে প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মৃত্তিকা ক্ষয়ও বাড়ছে। ফলে প্রাকৃতিক ছড়া-নালা বর্ষাকালে ধুয়ে আসা মাটিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে পানীয়জলের সংকট প্রকট হয়।


তবে সংগঠনটি জুম চাষের জন্য কোনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অপরাধের দৃষ্টিতে না দেখে জুম চাষীদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী বিকল্প চাষাবাদ পদ্ধতি চালুর ওপর জোর দিয়েছে। আদি পদ্ধতির এ জুম চাষ বছরের পর বছর ধরে ধ্বংস করে দিচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। এভাবে বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীজ সম্পদ। জুম চাষীরা পুরো এক বছরের খাদ্য-শস্য ঘরে তুলতে পারলেও এ জুম চাষ পরিবেশকে বিপন্ন করছে।


জানা গেছে, জুম চাষ থেকে বিরত রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম নিয়ন্ত্রণ নামে বন বিভাগের একটি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া আশির দশকে সরকারি উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জুম চাষীদের পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় কয়েক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। স্থায়ীভাবে জীবনযাপনের মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় এ প্রকল্পটি কোনো কাজে আসেনি।


বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জুম চাষের ফলে পাহাড়ে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের বায়ুও দূষিত হয়ে পড়ে। জুমের নামে পাহাড় পোড়ানোর সময় স্থানীয় এলাকায় বাতাসে ছাইয়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে লোকজনের মাঝে নানা ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যাধি দেখা দেয়। অন্যদিকে পাহাড়ি মাটির রস দ্রুত শুকিয়ে শত শত পাহাড় ধসে পড়ে। হারিয়ে যায় পাহাড়ের বসবাসরত নানা জীবজন্তু। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ে পরিবেশের ভারসাম্য।


লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরে আলম বলেন, প্রতি বছর শত শত একর পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষ করা হয়। আর জুম চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে পোড়ানো হয় পাহাড়ের পর পাহাড়। তাই জুমচাষের ক্ষতিকারক দিকগুলো জুম চাষীদের মাঝে তুলে ধরে তাদের এ চাষের বিকল্প হিসাবে কমলাসহ মিশ্র ফসল চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে আগের তুলনায় জুম চাষের নামে পাহাড় পোড়ানো কমে এসেছে।


বিবার্তা/আরমান/সোহান

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com