মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৫৩
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক
রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্বগাথা আজও মনে পড়ে। যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে রণাঙ্গনে পাঠাতে তাঁর নানামুখী পদক্ষেপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মুক্তিযোদ্ধারা। পেশায় শিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সমাজেও ছড়িয়েছেন দ্যুতি। ফলে জেলার বাইরেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে।


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের শিবিরের হাট এলাকা) পিরোজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেরাশতুল্লাহ মণ্ডল ও সাহেরা বিবি দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর ভাই জালাল উদ্দিনও বীর মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষক হওয়ায় তিনি ‘রাজ্জাক মাস্টার’ নামে সুপরিচিত।


জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে ছাত্রজীবন শেষে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে আব্দুর রাজ্জাক রাজশাহীর তানোরে এসে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এলাকায় তাঁর সুনাম ছড়ায় অল্পদিনেই। ছাত্রজীবন শেষে চাকুরি জীবনে এসে দেশের মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, '৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন- প্রতিটি ঘটনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে নিজ জন্মস্থান সুন্দরপুর এলাকা থেকে ৫-৬ জনকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মালদহের জঙ্গিপুরের স্যাকারিপুরে যান। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সন্তোষ মৈত্রের পরামর্শে পুনরায় দেশে ফিরে আসেন- আরও বেশি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আরো তরুণ-যুবা সংগ্রহের উদ্দেশ্য। এই দফায় তিনি আরো ২০-২২ জনকে সাথে নিয়ে গৌড়বাগান ইয়্যুথ ক্যাম্পে ভর্তি করালে তাদের মূল ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। গৌড়বাগান ক্যাম্পে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া তরুণ-যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রাথমিক ট্রেনিং প্রদান করতেন তিনি।


ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসে ১ম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহীতে গেলে গণি দারোগার সাথে দেখা হয়। গনি দারোগা আমাকে বলেন, ‘আপনি লিস্টেড, আপনি তিন নম্বরে আছেন। এক নম্বরে আছে মুন্ডুমালার মতিউর রহমান, তিনে আপনিসহ ১৭ জন মোট।’ সেদিনই রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যাই। সেখানেও আমার নাম কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার খবর পাই। সেদিন রাতেই গ্রামের বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আমার ছোট ভাইসহ ৫-৬ জনকে নিয়ে ভারতে চলে যাই।’


আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসের ৮/৯ তারিখ ভারত গেছি। শামসুল হুদা, হেলাল এরা সাথে গেছিল, লালগোলায় উঠলাম। রাতে না খায়্যা, দিনে না খায়্যা জোহরপুর বর্ডার দিয়্যা নৌকা চালায়ে গেলাম। আসরের সময় উঠলাম সেকারিপুরে। তার পরদিন গৌড়বাগান ক্যাম্পে গেলাম। বাচ্চু ডাক্তার ছিল, মইনুদ্দিন, মজিবুর- এরা ছিল। সেখানে নাম লিখে নিল, আমার আন্ডারে ২০-২২ জন। আমাকে বলল, আপনি এডজুটেন্ট হয়ে থাকবেন। প্রায় ১৯০০ ছাইল্যা (ছেলে); ৩টা ভাগ করে। আমি একটাতে বক্তব্য রাখি, মইনুদ্দিন একটাতে বক্তব্য রাখে, ইংরেজির প্রফেসর ইবরাহিম আরেকটাতে। আবার মালদাহ ফিরে আসলাম। রাজশাহী থেকে যারা পালিয়ে আসলো- সেই ৪২ জনকে আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করি। জানতে পারি, আদমপুর ক্যাম্পে আমাদের ১৮ জনকে শত্রুপক্ষ ভেবে আটকানো আছে, অরা গেছে, কিন্তু অরাকে খাইতে দেইনি- আটকে রেখেছে। তারা এমএনএ‘র নাম বলতে পারছে না। তাদের গিয়ে বাঁচাই।’


এলাকাবাসী জানান, ওইসময় যুবকদের সংগ্রহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। তাদেরই একজন তালন্দ এ. এম. উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, উনি আমাকে বলেন- ‘তুমি চলো; অসুবিধা নাই, ইয়াং ছেলে। ম্যালা (অনেক) বুঝানোর পর আমি রাজি হলাম। আমাকেসহ আরো অনেককে রিক্রুট করার জন্য মালদাহতে একটা হল রুমে নিয়ে যায়। সেখানে রাজ্জাক সাহেব ছিলেন। উনি অর্গানাইজড করছেন, এটা আমি বুঝতে পারলাম। ছেলেদেরকে কালেকশন করছিলেন- মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুঝাচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন।’


বীর মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘উনি আমার শিক্ষাগুরু। একদিন দেখি আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে উনি এসেছেন আমাদের মতো তরুণ ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর জন্য। স্যারের অনুপ্রেরণায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ জন রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা ৫/৬ জন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করি।’


চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সুন্দরপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘ওনার জন্মস্থান এখানে। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। কিন্তু কাগজ-কলমে তানোরে। ৩০ বছর থেকে আমি ইউনিয়ন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছি, আগে ১৫ বছর করেছি। উনি (রাজ্জাক মাস্টার) আমাদের সিনিয়র। উনি ‘৭১-এ যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাতে লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়ার এলাকাতে তিনটা লোক। একটা রাজ্জাক মাস্টার, একটা মুনসুর ডাক্তার আর একটা শামসুল। আমি বাড়ি থাইক্যা গেছি মাত্র ৭টা টাকা লিয়্যা, বাপের পকেট থাইক্যা চুরি করে। তাও যাইতে যাইতে ঘাটাতে (রাস্তায়) কুনঠে (কোথায়) পইড়্যা (পড়ে) গেছে বুঝতে পারিনি। হামরাকে (আমাদের) লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়া, ইন্ডিয়া পৌঁছা পর্যন্ত, খরচা-খরচ সব উনাদের।’


বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একজন সফল সংগঠক। তিনি আমাকেসহ এলাকার প্রায় ৩০ জনকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছেন এবং সেখানে শিক্ষা দিয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার আমাকে সাথে করে ভারতে নিয়ে গেছে, নিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়েছে। উনি সংগঠক।’


তানোর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উনি লোক পাঠিয়েছেন ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। উনি আমার অনেক অনেক সিনিয়র। রাজ্জাক ভাই সম্মানীয় ব্যক্তি, এলাকার সব মানুষই তাকে সম্মান করে।’


চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার নামে তাকে চিনি। উনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, পাশাপাশি তাকে সংগঠকও বলা যায়। তার ভাই জালাল উদ্দিনও একজন মুক্তিযোদ্ধা, তারা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। আমি জানি, আব্দুর রাজ্জাক সাহেব গৌড় বাগান ক্যাম্পে অনেককে নিয়ে গেছেন। উনি গৌড় বাগান ক্যাম্পে গেছেন, ক্যাম্পে সুশৃঙ্খলভাবে রেখে এসেছেন। গুছিয়ে দিয়ে এসেছেন, সাহস-শক্তি জুগিয়েছেন। আবার উনি বাংলাদেশে ফিরে লোক নিয়ে গেছেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন।’


খাইরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য তার অনেক অবদান আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, দেশের জন্য বুঝিয়েছেন- স্বাধীনতা কী, স্বাধীনতা হলে কী সুবিধা আছে, আমরা কী অবস্থায় আছি। আমি মনে করি, তিনি বড় মাপের একজন সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা। উনি সম্মানিত শ্রদ্ধার ব্যক্তি।’


বিবার্তা/সোহানুর/এইচআর/জেএইচ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com