
বছরে আপ্যায়ন খাতে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ব্যয় করার নির্দেশনা থাকলেও ১৯ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করেছেন নরসিংদী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন ভূইয়া। পরিষদের সদস্যদের নিয়ে প্রতি মাসে মিটিং করার কথা থাকলেও আড়াই বছরে একবার মিটিং করেছেন। এ ছাড়া আড়াই বছরে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক, ভাতিজাসহ ১১ স্বজনকে মাস্টাররোলে চাকরি দিয়েছেন। এসব ছাড়াও অনেক অভিযোগ রয়েছে এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
এদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন ভূইয়ার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন পরিষদের সদস্যরা।
মঙ্গলবার (১৪ মে) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এই অনাস্থার আবেদন করেন তারা। পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যান ও সহযোগী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াহাব রাশেদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন পরিষদের সদস্যরা।
মো. মনির হোসেন ভূইয়া ২০২২ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন।
লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ২০২২ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মতিন ভূইয়াকে পরাজিত করে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনির হোসেন ভূইয়া। নির্বাচিত ছয়জন সাধারণ সদস্য ও দুজন সংরক্ষিত সদস্য নিয়ে পরিষদের প্রথম মাসিক মিটিং হয় ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর। বিধি অনুযায়ী, প্রতি মাসে মিটিং হওয়ার কথা থাকলেও আড়াই বছরে আর কোনো মাসিক মিটিং হয়নি।
২০২৩ সালের ২৪ জুলাই পরিষদের প্রথম বাজেট মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং ২০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদনসংক্রান্ত। সভার শুরুতেই চেয়ারম্যানের লোকজন একটি হাজিরা শিটে সদস্যদের স্বাক্ষর নেন। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেট কিংবা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কত টাকার বাজেট হয়েছে, কত টাকা আয়ব্যয় ও উন্নয়ন প্রকল্প খাতে কত টাকা বাজেট ধরা হয়েছে, তা কোনো সদস্যকে অবগত না করে বাজেট পাস করা হয়। কিন্তু অনুমোদিত বাজেটের কপি কোনো সদস্যকে দেয়া হয়নি।
কোনো সদস্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে পরিষদে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াহাব রাশেদের সহযোগিতায় চেয়ারম্যান উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করেই ও সদস্যদের অনুমতি ছাড়াই একতরফাভাবে প্রথমে ১০ কোটি ও দ্বিতীয় ধাপে ২০ কোটি টাকা এফডিআর করেন ব্যাংকে।
অন্যদিকে সদস্যদের না জানিয়ে চেয়ারম্যান মনির হোসেন ভূইয়া তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক, ভাতিজাসহ ১১ জনকে মাস্টাররোলে জেলা পরিষদে চাকরি দিয়েছেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যানের এসব অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াহাব রাশেদ।
জেলা পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের (সদর) সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন সরকার বলেন, ‘আমি দ্বিতীয় মেয়াদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এত অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচার কখনো হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা আপ্যায়ন বাবদ খরচ করার নির্দেশনা থাকলেও চেয়ারম্যান ১৯ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। কীভাবে করেছেন আমরা কেউ জানি না।’
এই সদস্য আরো বলেন, জেলা পরিষদ সরকারি প্রতিষ্ঠান। জেলার উন্নয়নের টাকা চেয়ারম্যান কাউকে না জানিয়ে সরকারি ব্যাংকে না রেখে মিডল্যান্ড ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে ৩০ কোটি টাকা এফডিআর করেছেন। চেয়ারম্যান জেলা পরিষদকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।
পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের (রায়পুরা) সদস্য রাজিব আহমেদ বলেন, ‘মানুষ আমাদের শুধু দাওয়াত খাওয়ানোর জন্য জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করেনি। আড়াই বছরে এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নিতে পারিনি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। লজ্জায় মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।’
পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের (মনোহরদী) সদস্য এ কে এম জহিরুল হক বলেন, ‘আমাদের না জানিয়ে চেয়ারম্যান তার আত্মীয়-স্বজনের নামে কতগুলো মাস্তান নিয়োগ দিয়েছেন। আমরা কিছু বললেই বেইজ্জতি করেন। চেয়ারম্যান অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে সবার সামনে আমাদের অসম্মান করেন। উন্নয়ন প্রকল্পের বদলে চেয়ারম্যানের কাছে বেইজ্জতি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা সবাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও নানা দপ্তরে অনাস্থা জানিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াহাব রাশেদ বলেন, ‘আমি সব কাজ বিধিসম্মতভাবেই করে যাচ্ছি ও চেষ্টা করছি। মাসিক মিটিং নিয়মিত করা সম্ভব হয় না। এটা এখানকার রীতি। তিন-চার মাসে একবার মিটিং হয়। এখন যদি সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন তাহলে তো বাধা দিতে পারব না।’
অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘এখানে সব ডকুমেন্টস রয়েছে। মনগড়া কোনো অভিযোগ দিলে লাভ হবে না। ২০২২-২৩ সালে আগের পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এককভাবে আপ্যায়ন বিল বাবদ ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬০ টাকা উত্তোলন করেছিলেন। চলতি অর্থবছরে আমার ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও আমি খরচ করেছি তিন লাখ ৪০ হাজার ১৮৫ টাকা।’
চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের বাইরে যে টাকা অলস পড়ে ছিল, সেই টাকা এফডিআর করেছি। তা থেকে মাসে ৩১ লাখ টাকা লাভ আসে। সেটা পরিষদে ব্যয় হয়। ১১ জন নিয়োগের মধ্যে দুজন চালক, একজন ইমাম, শূন্য পদে চারজন ও দুজন দারোয়ান নিয়োগ দিয়েছি। কেউ আমার স্বজন নয়।’
চেয়ারম্যান বলেন, আমি সদস্যদের অনিয়মের প্রশ্রয় দেইনি। বলেছি, মসজিদ ও গোরস্তান থেকে টাকা না খেতে। তারা বলেন, ‘টাকার মধ্যে কারো নাম লেখা থাকে না।’ সব উন্নয়ন প্রকল্প সদস্যরা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করেন। আমি দেখিও না। অল্প বয়সে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি। তার মর্যাদা রক্ষায় যত ঝড় আসুক আমি মোকাবেলা করব।
বিবার্তা/কামাল/জবা
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]