কুমুদিনী হাজং: শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় টংক আন্দোলনের শেষ বীরের প্রস্থান
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪, ২২:১৬
কুমুদিনী হাজং: শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় টংক আন্দোলনের শেষ বীরের প্রস্থান
নেত্রকোণা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় নেত্রকোণায় ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের অকুতোভয় সৈনিক সংগ্রামী কুমুদিনী হাজংকে শেষ বিদায় জানালেন স্বজন, আদর্শিক সহযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ।


২৪ মার্চ, রবিবার দুপুরে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রামের শ্মশানঘাটে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।


শেষ কৃত্য সম্পন্নের আগে বামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা কুমুদিনী হাজংয়ের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।


এর আগে, যে মানুষটিকে ঘিরে টংক আন্দোলনের বিদ্রোহ জ্বলে উঠেছিল সেই প্রিয় মুখ কুমুদিনী হাজংয়ের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড মনি সিংহের ছেলে দিবালোক সিংহ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজংসহ শত শত মানুষ।


কুমুদিনী হাজংয়ের ছেলে অর্জুন হাজং বলেন, মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। মারা গেছেন। তাঁর আত্মার শান্তির জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন।


কুল্লাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা উজ্জ্বল বলেন, কুমুদিনী হাজং ছিলেন আমাদের ইউনিয়নের গর্ব। তিনি টংক আন্দোলনের নেত্রী। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোক জানাই। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।


বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তর হাজং বলেন, কুমুদিনী হাজং ছিলেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। আমরা হাজং ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এই কিংবদন্তিকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।


বৃহত্তর ময়মনসিংহের সুসং জমিদারি এলাকায় টংক প্রথার প্রচলন ছিল। ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে জমিদারকে দিতে হবে। ১৯৩৭ সালে শোষিত কৃষকেরা এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, যা টংক আন্দোলন নামে পরিচিত।


কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে টংক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয় দুর্গাপুরের হাজং সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এরই অংশ হিসেবে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং অন্দোলনে জড়িত হন। তৎকালীন পুলিশ ১৯৪৬ সালে ৩১ জানুয়ারি বগেরাতলী গ্রামে হানা দিয়ে কুমুদিনী হাজংকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে রাশিমনি হাজংয়ের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এসময় কুমুদিনী হাজংকে পুলিশ নিতে পারেনি। তবে সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রাশিমনি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজং। পুলিশেরও দুজন সদস্য নিহত হয়। সেই ঘটনার পর কুমুদিনী হাজংকে ঘিরে জ্বলে উঠে টংক আন্দোলন।


তাঁর সহযোদ্ধারা বলছেন, আজীবন যে সাম্য সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে গেছেন কুমুদিনী হাজং সেই স্বপ্নের সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে চান। তাঁর জীবনকর্ম ও ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।


কমিউস্টি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দিবালোক সিংহ বলেন, তিনি যে লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন কর্মী ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এই দেশের কৃষক, মেহনতি মানুষ, জনতার স্বার্থের একটি সাম্যের সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন। আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের তিনি যে সংগ্রাম করেছেন সেই সংগ্রামের মৃত্যু নেই, মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ একদিন প্রতিষ্ঠা হবেই।


উপজেলা আদিবাসী ইউনিয়নের সভাপতি অবস্তী কান্ত হাজং বলেন, কমরেড কুমুদিনী হাজং একজন মহান নেত্রী। তাঁর ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই। আমরা তাঁর জীবন ও ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারের কাছে দাবি জানাই।


এর আগে, শনিবার (২৩ মার্চ) কুমুদিনী হাজং বহেরাতলী গ্রামের তার নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


কুমুদিনী হাজং দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত শয্যাশায়ী ছিলেন। দেখভাল করেছেন মেঝ ছেলে অর্জুন হাজং ও তার স্ত্রী। টংক আন্দোলন নেত্রী রাশিমণি হাজং স্মৃতিসৌধ দেখতে গিয়ে সকলেই কুমুদিনী হাজংকে এক নজর দেখে আসতেন। শুনে আসতেন ব্রিটিশ বিরোধী টংক আন্দোলনের জন্য নিহত শহিদদের কথা, টং প্রথা বিলুপ্তির ইতিকথা।


জমিদারদের অন্যায্য খাজনা আদায়ের প্রতিবাদে ব্রিটিশ বিরোধী টংক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই। সেই সময় রাজ সেনার বিরুদ্ধে কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তিনি।


টংক আন্দোলনের ইতিহাসের শেষ সাক্ষী কুমুদিনী হাজং শত বছর বেঁচে ছিলেন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে বিজয়পুর সীমান্তের একটি গ্রাম থেকে খাজনা প্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনের গণজাগরণ হয়েছিল। এ আন্দোলনে ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত রাশিমণি হাজংয়ের স্মৃতি ধরে রেখেছিলেন কুমুদিনি হাজং।


১৯৪৬ সালের কথা। কমরেড মণিসিংহ ভারত থেকে দুর্গাপুর মামার বাড়িতে চলে আসেন। শুরু করেন টংক প্রথা বা ধান কড়াড়ি খাজনা বাতিল আন্দোলন। আন্দোলনে যোগ দেন সীমন্তের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের লঙ্কেশ্বর হাজং, রাশিমণি হাজংসহ আদিবাসীরা।


এরই জেরে সে বছরের ৩১ জানুয়ারি লঙ্কেশ্বর হাজংসহ বেশ কজন হাজং বিদ্রোহী নেতাকে ধরে নিতে ব্রিটিশ ফন্ট্রিয়ার পুলিশ আসে বহেরাতলী গ্রামে। তাদের না পেয়ে লঙ্কেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী কুমোদিনি হাজংকে তুলে নিয়ে যায়।


এ খবর এক কৃষক বিদ্রোহ সভায় রাশিমণি হাজংয়ের কাছে পৌঁছে। ছুটে যান তিনি। নারীকে নিয়ে যাওয়া মানে মান নিয়ে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতে থাকা দা দিয়েই পুলিশর ওপর হামলা চালান। পরে পুলিশের বন্দুকের গুলিতে তিনিসহ দুজন হাজং নেতার প্রয়াণ ঘটে। তবে রক্ষা পান গৃহবধূ কুমুদিনি হাজং।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com