জীর্ণদশায় চারশ বছরের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন আতিয়া মসজিদ
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৭
জীর্ণদশায় চারশ বছরের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন আতিয়া মসজিদ
ইমরুল হাসান বাবু
প্রিন্ট অ-অ+

প্রাচীন স্থাপত্যের এক নিদর্শন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত আতিয়া জামে মসজিদ। চারশ বছরের পুরোনো এই মসজিদটি এখনও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।


তবে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না হওয়ায় জীর্ণদশায় দশ টাকা নোটের আতিয়া মসজিদটি। এটি প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগ মসজিদটির তত্ত্বাবধান করছে। সকলের দাবি মসজিদটির সংস্কারসহ দশ টাকার নোটে আবারো ফিড়িয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদের ছবি।


জানা যায়, ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর মাঝে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। ইতিহাসখ্যাত বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খানের শাসনামলে মসজিদটি নির্মিত হয়। ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। তিনি ছিলেন সোনারগাঁ অঞ্চলের শাসক। বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ তখন সোনারগাঁও অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শাসন কার্যপরিচালনার সুবিধার্থে ঈশা খাঁ টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়ায় পরগণা সৃষ্টি করেন। সে সময় আতিয়া পরগণার শাসনভার ন্যস্ত হয় ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর ওপর।


টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে ৭ কিলোমিটার দূরে লৌহজং নদীর তীরে ঐতিহাসিক এই মসজিদটির অবস্থান। এর নির্মাণ প্রায় ৪০০ বছর আগে হলেও মসজিদটি প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য শিল্পকর্মের নিদর্শন হওয়ায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাচীন এই মসজিদটির আয়তন বাইরের দিকে ২০ দশমিক ৯ মিটার ও ১৬ দশমিক ১৩ মিটার। মসজিদের প্রাচীর ২ দশমিক ৭২ মিটার (দশমিক ৫ ফুট) প্রশস্ত বা দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট এবং উচ্চতা ৪৪ ফুট।


মসজিদের চার কোণায় রয়েছে চারটি বিশাল আকারের অষ্টকোণাকৃতির মিনার। স্ফীত রেখার সাহায্যে অলঙ্কৃত মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে উঠে গেছে। চূড়ায় রয়েছে কারুকার্যময় সুন্দর ছোট ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলোর গায়ে বিভিন্ন রকমের কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।


মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে দুটো করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে ৩টি সুন্দর মেহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেয়ালের সঙ্গে দুইটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষের উপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। মাঝখানের প্রবেশপথের উপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও সেখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তীকালে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। বর্তমান শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আতিয়া মসজিদ নির্মাণ হয় ১০১৮ হিজরিতে।


আরও জানা যায়, ১৬০৯ সালে বায়েজিদখান পন্নীর পুত্র সাঈদখান পন্নী মসজিদটি নির্মাণ করেন। টাঙ্গাইলের করটিয়ার বিখ্যাত পন্নী জমিদার বংশের আদি পুরুষ হলেন সাঈদ খান পন্নী। মসজিদের পশ্চিমদিকে অবস্থিত ফটকের ডানদিকে আরেকটি শিলালিপি আছে। ইংরিজেতি লেখা এই শিলালিপি পাঠে জানা যায়, ১৬০৯ সালে সাঈদ খান পন্নী এটি নির্মাণ করেন। এরপর ১৮৩৭ সালে মসজিদটি সংস্কার করেন দেলদুয়ার জমিদার বাড়ীর সদস্য রওশন খাতুন চৌধুরাণী। পরে দেলদুয়ারের জমিদার আবু আহম্মদ গজনবী ও করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীসহ কয়েকজন মিলে ১৯০৯ সালে পুনরায় মসজিদটি সংস্কার করেন। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের অধীনে মসজিদটির তত্ত্বাবধায়ন করা হচ্ছে।


দশনার্থীরা জানান, ঐতিহ্যবাহি এই মসজিদটি সংস্কারের পাশাপাশি সুন্দর ব্যবস্থাপনা দরকার। এখানে সব ধরনের মানুষ ঘুরতে আসেন। যে দশ টাকার নোটে মসজিদের ছবি ছিল সেই টাকায় পুনরায় ছাপানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। যেন নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানতে পারে দশ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি ছিল।


কুমিল্লা থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, অনেক বছরের পুরাতন এই মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেছি। খুব ভালো লেগেছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই মসজিদটি এখনও অনেক সুন্দর। দশনার্থী বাড়াতে মসজিদটির সংস্কার করা দরকার। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে মসজিদটি। সরকারের কাছে দাবি অতি দ্রুত মসজিদটি সংস্কার করা হোক।


আরেক দর্শনার্থী সাভার থেকে ঘুরতে আসা সাদেক আলী বলেন, আগের দশ টাকার নোটে দেখেছিলাম এই মসজিদের ছবি। তারপর ইচ্ছে হলো এই মসজিদ দেখার। দেখে অনেক ভালো লেগেছে। সরকারের কাছে দাবি সংস্কারসহ দশ টাকার নোটে আবারো ফিড়িয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদের ছবি।


স্থানীয় জব্বার মুন্সী বলেন, সংস্কার না করার কারণে মসজিদটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে আমাদের এই মসজিদ সংস্কার করে দিলে মসজিদটি সুন্দর হবে। দশ টাকার নোটে আবারো ফিড়িয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদ। এই মসজিদটি দশ টাকার নোটে ছিল যেন নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা ঐতিহ্য জানতে পারবে ও দেখতে পারে। সরকারের কাছে এটি দাবি আমাদের।
দেলদুয়ার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আলী বলেন, সংস্কারের অভাবে ঐতিহ্যবাহি একটি মসজিদ ধ্বংস ও নষ্ট হয়ে যাবে তা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা প্রশাসনের পক্ষে থেকে কৃর্তপক্ষকে জানানো হবে। যেন এই মসজিদটি বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। যাতে করে এই সংস্কারের ফলে আরও দর্শনার্থীরা মসজিদটি দেখতে আসে। এটি সংস্কার করে আরও দৃষ্টিনন্দন করতে চাই।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com