শিরোনাম
সবচেয়ে সস্তা আবাসিক হোটেল
প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৯, ১৫:০৩
সবচেয়ে সস্তা আবাসিক হোটেল
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

পুরান ঢাকার সদরঘাটের ওয়াইজ ঘাটে সারিবদ্ধভাবে বাধা কিছু ভাসমান লঞ্চ, আসলে এগুলো লঞ্চ না, ভাসমান হোটেল। যেগুলো এরই মধ্যে দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা হোটেলের সুনাম কুড়িয়েছে।


এরই মধ্যে লঞ্চে উঠতে-নামতে যাত্রীদের ব্যস্ততা, কুলিদের চিৎকার-চেঁচামেচি, মাঝি-মাল্লাদের হাঁকাহাঁকির মাঝেই সূর্যের অস্তরাগ কালো পানির মলিনতা আর দুর্গন্ধ আড়াল করে দিল মন থেকে। ব্যস্ত এই শহরে প্রথম পা রাখলেন আব্দুল খালেক। বরিশাল ফিরতি লঞ্চে নেমেই ছোট্ট একটি কাগজের টুকরো এগিয়ে দিলেন, ‌‘চাচা, এই ঠিকানায় কিভাবে যাবো?’ ‘এটাতো কাছেই, পাশের ঘাটে’। ‘চেনেন না, নিয়ে যেতে হবে’ এমন আবদারে তাকে নিয়ে গেলাম ওয়াইজ ঘাটে। যেতে যেতে গল্প বাধলাম তার সঙ্গে, তিনি এসেছেন তার ভাতিজার কাছে। নাম শাহিন, বাসা-বাড়ি নেই থাকেন ভাসমান হোটেলে। তিনিও এসেছেন ভাতিজার মতো কুলির কাজ করতে, মাথা গুঁজবেন এই ফরিদপুর মুসলিম হোটেলেই, যা শুধু ঢাকা নয়, পুরো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সস্তা হোটেল।



এত হোটেল থাকতে কেন এখানে কেন থাকবেন? প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন আব্দুল খালেক! তবে কৌতুহলবশত এগিয়ে গেলাম হোটেলের ভেতর। ঢুকতেই দেখা মিললো গোলাম মোস্তফা নামের মধ্য বয়স্ক একজনের। তিনিই এই হোটেলের ম্যানেজার, তিনিই মালিক! সকাল ৬টা থেকে রাত ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত এই রুমেই থাকেন। তারপর হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।


তার এই হোটেল সম্পর্কে জানতে চাওয়া মাত্রই তিনি বলেন, এটা কম আয়ের মানুষের হোটেল। এখানে ৩৫ টাকায়ও থাকা যায়, আবার ১০০টাকারও কেবিন আছে।


গল্পে খানিকটা বিরতি দিয়ে ঘুরে দেখতে লাগলাম পুরো হোটেল। এই হোটেলে ৩৫ টাকায় যেসব সুবিধা মেলে তাকে আশাতীতও বলা চলে। ঘরগুলো খুব ছোট হতে পারে। প্রতিটি কক্ষেই আছে একটি খাট, বালিশ, কাঁথা ও ফ্যান। পানি এবং টয়লেটের ব্যবস্থা ঠিকই আছে। চাইলে গোসলও সেরে নেয়া যায় হোটেলেই। তবে খাবার আলাদা করে কিনে খেতে হয়, সেটাও সামনের হোটেলে ১৫ টাকায় পাওয়া যায়।



জানা যায়, ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের যাত্রা শুরু ১৯৬৮ সালে। এটিই দেশের প্রথম ভাসমান হোটেল। তখন হিন্দু হোটেল নামেই এটির পরিচিত ছিল। সেসময় মাত্র ৪ টাকাতেই এখানে মিলত থাকা-খাওয়া। এই হোটেলের শুরু থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ২০০২ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই হোটেলে মানুষের রাত্রিযাপন বন্ধ হয়নি একটি দিনের জন্যও। গোলাম মোস্তফা মিয়া প্রায় ৩৩ বছর ধরে হোটেলটি চালাচ্ছেন।


হোটেলটিতে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষও। গোলাম মোস্তফার কথায় জানতে পারলাম, ঈদ, পূজায়ও এই হোটেল বন্ধ হয় না। তিনি গত ৩৩ বছরে মাত্র ৫টি ঈদ উদযাপন করেছেন গ্রামের বাড়িতে। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে থাকে পরিবার। মা-বাবা, এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মোস্তফা বলেন, ‘বছরে দু-একবার যাওয়া হয়। গিয়ে কি করবো, আমার পরিবার তো চলে এই হোটেলের টাকায়। আর আমি বাড়ি গেলে তখন পুরো হোটেল সামলাতে হয় হাবিবুর রহমানকে।’


হাবিবুর রহমান এই হোটেলের একমাত্র কর্মচারী, যাকে ৮হাজার টাকার বিনিময়ে হোটেলের সবকিছুই দেখা-শোনা করতে হয়। এই হোটেলে তার চাকরির বয়স ৭বছর। এক সময় সে সদরঘাটে ফল বিক্রি করতো। তখন সে এই হোটেলের বাসিন্দা ছিল। ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে এখানে চাকরি নিয়েছেন তিনি।


হাবিবুর রহমান বলেন, ভালোই কাটে এখানে। থাকা-খাওয়া ছাড়া যে টাকা পাই তাতেই সংসার চলে। আর এখানে যারা থাকেন তাদের খুব আপন মনে হয়। শীতের মৌসুম, ঈদ ও পূজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় আসেন। তখন সব রুম ভাড়া হয়। ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ফল ব্যবসায়ীরাই বেশি থাকেন এই হোটেলে। তবে আগের থেকে কমে গেছে হোটেলে অতিথির সংখ্যা। এখন মানুষ হোটেল দেখার আগে সাজসজ্জা দেখেন। এখানে তো আর এসব নেই।


এই ভাসমান হোটেলে মোট ৪৮টি বিছানা রয়েছে। সেখানে দিনভিত্তিক ছাড়াও মাসভিত্তিক সিট ভাড়া দেয়া হয়। মূলত ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় আসা ব্যক্তিরা এখানে রাত কাটায়। অনেকে মাসের পর মাস এখানে থাকেন। কারণ যে টাকা দিয়ে একবেলা পেট ভরে খাওয়া যায় না, সেই টাকায় এখানে রাতযাপন করা যায়! রাত ১২টা পর্যন্ত এ হোটেলগুলোতে প্রবেশ করা যায় ও পরের দিন সকাল ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে কোনো দরিদ্র শ্রমিককেই টাকার অভাবে বেশিরভাগ সময় ফিরিয়ে দেয়া হয় না। বোর্ডিংয়ের এক কোণে তাদের মাথা গোঁজার একটু ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।



রাত ৮টা, হোটেলে ফিরলেন ৭৯ বছর বয়সী আবদুর রহমান। তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে ফরিদপুর মুসলিম হোটেলে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার পালং থানার বিনোদপুর গ্রামে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তিনি কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কোনো কাজ না পেয়ে সদরঘাট টার্মিনালে পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরপর থেকেই এই হোটেলের নিয়মিত বাসিন্দা হয়ে যান তিনি।


হোটেলের সামনেই খাবারের দোকান, যেখানে খুবই সস্তায় খাওয়া যায় । আবদুর রহমান বলেন, সত্তরের দশকে ওয়াইজ ঘাটের এসব ভাসমান হোটেলে খাবারের বিল পরিশোধ করলেই রাতযাপন করা যেত। কোনো ভাড়া নেয়া হতো না। মাছ, ভাত বা মাংস যা খাওয়া হোক, খরচ ছিল কম। আর এখন থাকার জন্য দিই ৪০ টাকা। তারপরও এ হোটেলের মায়া ছাড়তে পারি না। আব্দুর রহমান এখন খাবারের দোকান দিয়েছে হোটেলটির ঠিক সামনেই। তার হোটেলে ১৫ টাকায় ডাল, ভাত, ভর্তা পাওয়া যায়। ভাসমান হোটেলের বাসিন্দারাই তার দোকানের ক্রেতা।


আব্দুর রহমানের সঙ্গে কথা শেষ হতেই এগিয়ে এলেন আরেকজন। নাম ফুল মিয়া, বরিশালে তার বাড়ি। তিনি নিজেই জানালেন গত এক মাস ধরে এই হোটেলে থাকছেন। সদরঘাটের কুলির কাজ করেন তিনি। কম টাকায় নিরাপদে থাকতে পেরে তিনি খুশিও।



ফুল মিয়া বলেন, আমরা আয় করি অল্প, তাই কম দামে থাকতে হয়। নয়তো রাস্তায় থাকতে হতো। কলিমুল্লাহ মিয়া মুসলিম হোটেলে অনেকবছর ধরেই থাকেন। তিনি বলেন, আগে ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হতো। নৌকায় মালামাল নিয়ে সদরঘাট আসতাম। সেসময়ও আমি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ভাসমান হোটেলে থাকতাম। সেসব হোটেল হিন্দুরা চালাত বলে তার নাম ছিল হিন্দু। সর্বশেষ ৫ টাকা ভাড়ায় সেখানে থেকেছি।


ঢাকা আসলেই যাদুর শহর। এখানে এক রাতে লাখ টাকা খরচ করেও থাকা যায়, আবার নামমাত্র মূল্যেও হোটেল সেবা পাওয়া যায়। অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মতে, বিশ্বে এর চেয়ে সস্তা আবাসিক হোটেল আর নেই।


অনুসন্ধানে জানা যায়, হাউসবোট থেকে নৌকায় ভাসমান হোটেলের চিন্তা ভাবনা আসে। ভাগ্যকুলের কুণ্ড জমিদার ও ঢাকার নবাবদের একাধিক তরী বুড়িগঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় থাকত। এসব প্রমোদতরী রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যবহার করা হত। এরমধ্যে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে ঢাকায় এসে কুণ্ডুদের প্রমোদতরী নবাবদের হাউস বোট ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া ব্রিটিশদের প্রমোদতরী ম্যারী এন্ডুসনের পরে পাগলা ঘাটে ভাসমান রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হত।


কয়েক বছর আগে আগুনে ওই প্রমোদতরীটি ধ্বংস হয়। ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে তার সুবেদার খাঁ চিশতীকে সেখানে পাঠান। চাঁদনী নামে এক প্রমোদতরীতে করে তিনি দলবলসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নামেন। সে স্থানটি পরে ইসলাপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। আর যেখানে চাঁদনী প্রমোদতরী রাখা হত, সেখানকার নামকরণ করা হয় চাঁদনী ঢাকা। এখনও চাঁদনী ঘাট রয়ে গেছে কিন্তু সেখানে কোনো প্রমোদতরী নেই।


বিবার্তা/আদনান/আকবর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com