শিরোনাম
প্রথম শহীদ মিনারের উদ্যোগ : পঞ্চায়েতের সেকাল-একাল (শেষ পর্ব)
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০১৯, ০৯:২৪
প্রথম শহীদ মিনারের উদ্যোগ : পঞ্চায়েতের সেকাল-একাল (শেষ পর্ব)
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

একুশের ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই পঞ্চায়েতের ভূমিকা রয়েছে। পিয়ারু সরদার ছিলেন ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েত প্রধানের অন্যতম। ২১ ফেব্রুয়ারির একদিন পরেই ছাত্ররা মনস্থির করে যে, ভাষা শহীদদের স্মরণে তারা একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করবেন। যে স্থানে গুলি হয়েছে সেখানে নির্মাণ করবে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নাম খচিত স্মৃতির মিনার। এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভই পরে হয়ে ওঠে ‘শহীদ মিনার’।


২৩ ফেব্রুয়ারির আগেই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের’ নকশা তৈরি করা হয়। মেডিক্যাল কলেজ ভবনের সম্প্রসারণের যে কাজ চলছিল তার ঠিকাদার ছিলেন পিয়ারু সরদার। সেখানে কাজের জন্য যে বালু ও ইট মজুত ছিল শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য তা ছিল পর্যাপ্ত। কিন্তু সিমেন্ট রাখা ছিল তালাবদ্ধ গুদামে। গুদামের চাবিটি ছিল খোদ পিয়ারু সরদারের কাছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দু’জন ছাত্রকর্মীকে পাঠানো হয় তার কাছে সিমেন্টের জন্য আবদার নিয়ে। সব শুনে পিয়ারু সরদার নিঃশব্দে বাড়ির ভেতরে গেলেন। চাবি হাতে ফিরে এসে তা ছাত্রদের হাতে তুলে দিলেন।


শুধু বললেন, কাজ শেষ করে পরদিন যেন চাবিটি তাকে ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এভাবে পিয়ারু সরদারের সম্মতিতে ইট, বালু, সিমেন্ট জোগাড় হয়ে যায়।


বলছিলেন পিয়ারু দাসের দৌহিত্র পিয়ারু অ্যান্ড সন্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক গোলাম আলী।



তিনি বলেন, এই সম্মতি দেয়াতে পিয়ারু সরদারের উপর বড় ধরনের বিপদও নেমে আসার শঙ্কা ছিল। তিনি তার পরোয়া করেননি। সেই প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারটি ২৬ ফেব্রুয়ারি ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পিয়ারু সরদারের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং তার তত্ত্বাবধানে সেটি আবার আরো বড় করে নির্মাণ করা হয়েছিল।


পিয়ারু সরদারের আরো কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় পঞ্চায়েত জাদুঘরের কিছু বই থেকে। সেসব বইয়ে বলা আছে, পিয়ারু সর্দার ছিলেন হোসনি দালান, বকশিবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, উর্দু রোড, নূরকাতা লেন, আজিমপুর, পলাশীসহ বিভিন্ন মহল্লার সর্দার। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল মানুষ। এ দেশের প্রথম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের অফিস ছিল তার এলাকায়। মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা পুলিশের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাত্ররা পিয়ারু সর্দারের মহল্লায় এসে আশ্রয় নিত।


তখন ঢাকা শহরে এত দালানকোঠা ছিল না। প্রায় ফাঁকা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হলে ছাত্ররা রেললাইন পার হয়ে হোসনি দালানে এসে নিরাপদ বোধ করত। সে সময় পিয়ারু সর্দার তার মহল্লায় তল্লাশি থেকে পুলিশকে নিবৃত রাখতেন, সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন।



সে সময় পঞ্চায়েতের মর্যাদা ও ক্ষমতা এতটাই বেশি ছিল যে, মহল্লার পঞ্চায়েতের রায়ের বিরুদ্ধে সাধারণত কেউ আপিল করতে যেতেন না। মহল্লা পঞ্চায়েতকে সহজে কেউ ঘাঁটাতে চাইতেন না। মহল্লার পঞ্চায়েতের রায় যদি কেউ না মানার সাহস দেখাতেন তবে তাকে একঘরে করা হত। সামাজিকভাবে এ বর্জন পরিচিত ছিল ‘বুন্দ’ নামে। যে ব্যক্তির ওপর এ ‘বুন্দ’ জারি করা হত তার ‘সবর্নাশ’ হয়ে যেত। ওই ব্যক্তি যদি নিজের মহল্লা ছেড়ে অন্য মহল্লায়ও যেত তাহলেও সেই ‘বুন্দ’ জারি থাকত।


ঢাকা শহরে তার পক্ষে তখন বসবাস করা হয়ে উঠত অসম্ভব। আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আরেক ধরনের শাস্তি ছিল। অপরাধীর পেটে কাঁঠাল বেঁধে বেত মারা হতো এবং তারপর বলা হতো দৌঁড়াতে। এরপর সরদার সন্তুষ্ট হলে অপরাধী মুক্তি পেত। শহরের সমস্ত সরদারদের একটি ‘কাউন্সিল’ ছিল। এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে। কোনো সরদার কোনো কারণে অভিযুক্ত হলে এই কাউন্সিলে তার বিচার হতো এবং কাউন্সিলের রায় তাকে মেনে নিতে হত।


অবশ্য কাউন্সিলের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে, সরদারের অধিকার ছিল পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধায়কের কাছে আপিল করার। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের রায়ই ছিল চূড়ান্ত।


আজিমপুরের বাসিন্দা হাজি ফারুক হোসেন বিবার্তাকে পঞ্চায়েত সম্পর্কে বলেন, আমার বাবা, দাদা সবাই আজিমপুরেরই বড় হয়েছেণ। তারা পঞ্চায়েতের অনেক কিছুই দেখেছেন, আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তবে তাদের মুখে শুনেছি অনেক কিছু। যুদ্ধের আগেও যখন আমরা যুবক ছিলাম, আমাদের পুরান ঢাকার কোনো বিবাদ হলে সেটা থানা পুলিশে যেত না, মুরুব্বিরা মিলেই সেটার সমাধান হত। পঞ্চায়েতও অনেকটা এরকমই ছিল।


নিজেদের মধ্যেই বিবাদ মিটাতে পারলে আদালতের দরকার কি ? প্রশ্ন করেন হাজি ফারুক।


আবারো পঞ্চায়েত চালু করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা বা চালু হলে তারা সেটায় সম্মত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রাণের দাবি এটা। বছর তিনেক আগে আমরা এলাকার বাসিন্দারা মিলে একটা মানববন্ধনও করেছিলাম পঞ্চায়েত বহাল করার জন্য। পঞ্চায়েতের বিচারে আমাদের পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।


পঞ্চায়েতের আরেকটি কাজ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে সাহায্য-সহযোগিতা করা। যে দুটি ধর্মীয় উৎসব পালনে পঞ্চায়েতকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে হত তা হল মুহররম ও ফাতেহা-ই-ইয়াজ্দাহ্।



পঞ্চায়েতের আয়ের নির্দিষ্ট কয়েকটি উৎস ছিল। মহল্লার প্রত্যেক নতুন অধিবাসীকে পঞ্চায়েতের সদস্য হওয়ার জন্য চাঁদা দিতে হত। মহল্লার যে কোনো বিয়েতে, কনের মহল্লার পঞ্চায়েত বর পক্ষের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নজরানা নিত। এ ব্যাপারে প্রতিটি মহল্লায় নিজস্ব রেট ছিল। এ নজরানার নাম ছিল পঞ্চায়েতই-রাকাম। যদি কনের পিতা মহল্লার অন্য কারো জমিতে বা বাড়িতে বসবাস করতেন তাহলে বরকে ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ছাড়াও দিতে হত আরো কিছু অর্থ। এর নাম ছিল হাক্কি-ই জামিনদার। যার পরিমাণ সাধারণত এক টাকার বেশি হতো না। পঞ্চায়েত ওই টাকা দিয়ে দিত কনের পিতার বাড়িওয়ালাকে।


কনের মহল্লার মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বরকে কিছু টাকা দিতে হত। এটা পরিচিত ছিল হক-ই-আল্লাহ নামে। পঞ্চায়েতের স্থাবর সম্পত্তি ছিল পঞ্চায়েতের ঘর যা পরিচিত হতো ‘বাংলা’ নামে। এ ‘বাংলায়’ দিনে মক্তব বসত মহল্লার ছেলেমেয়েদের জন্য। আর রাতের বেলা তা পরিণত হতো মহল্লা ক্লাবে। ‘বাংলায়’ ব্যবহৃত ও রক্ষিত জিনিসপত্র যেমন- শতরঞ্জি, বাতি, হুঁকো, গোলাপপাশ, সামিয়ানাও ছিল পঞ্চায়েতের সম্পত্তির অন্তর্গত। পঞ্চায়েত তহবিলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সরদার।


এভাবেই কালের সাক্ষী আর বর্তমানের অবহেলার ভাজে ভাজে এখনো ধুকে ধুকে টিকে আছে পুরানো ঢাকার পঞ্চায়েত রীতি। এখনো পুরান ঢাকার অনেকের ইচ্ছা পঞ্চায়েতকে পুনর্বহাল করার, তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে সেটাই সময়ের প্রশ্ন!


বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com