
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী এই শিক্ষকের বাসাও বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে গত দুই বছরেও বাতিল হয়নি চাকরিচ্যুত এই শিক্ষকের বরাদ্দকৃত বাসা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসেও এই সংক্রান্ত কোনো চিঠির কপি দেয়া হয়নি। ফলে এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের দায়সারা ভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধের অনুসারী ছাত্র-শিক্ষক মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জানা যায়, বিএনপিপন্থী সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক এই শিক্ষক পৃথকভাবে দুইবার গণমাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর শাসন আমল, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া তথ্য পরিবেশন করেছেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক জরুরী সভায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের পর তার বেতন-ভাতা বন্ধসহ আবাসিক সুবিধাও বাতিল হওয়ার কথা।
কিন্তু অব্যাহতিপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের বেতন-ভাতা বন্ধ হলেও বাতিল হয়নি আবাসিক সুবিধা। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ফুলার রোডের ৩৭ নম্বর আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২৮০০ বর্গফুটের বাসায় বসবাস করছেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান বলছেন, তার অব্যাহতির বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় আছে। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, তিনি তা মেনে নিবেন।
তবে এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে প্রমাণের ভিত্তিতে অধ্যাপক মোর্শেদকে অব্যাহতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী বডি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের পরও গত দুই বছরে তার বরাদ্দকৃত বাসা বাতিল করা হয়নি। ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে এমনটি হয়েছে বলে দাবি তাদের।
এদিকে, রবিবার (১৯ জুন) রাতে বিএনপি সমর্থিত সাদা দলের শিক্ষক ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলামের আমন্ত্রণে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আসেন। সেখানেও ছিলেন অব্যাহতিপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের এখানে আড্ডা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনায় নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক মোর্শেদের রাজনৈতিক তৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। তারা বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) এক বিবৃতিতে মোর্শেদ হাসান খানের আবাসিক সুবিধা বাতিল করার জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বিবার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার দায়ে অধ্যাপক মোর্শেদকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার আবাসিক সুবিধা বাতিল করা হয়নি। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
তিনি বলেন, আমরা এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আল্টিমেটামও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাও আমাদের কথা রাখা হয়নি। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এই ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অবিলম্বে তাকে বাসা থেকে উচ্ছেদ না করলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দেবো। প্রয়োজনে আইনের আশ্রয়ও নেবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস শিক্ষকদের বাসা বরাদ্দের যাবতীয় বিষয় সম্পাদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বাসা বরাদ্দ কমিটির প্রধান।
অব্যাহতির পরও অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবন ব্যবহার করছেন, এমন অভিযোগের প্রেক্ষিত জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, ওনাকে (অধ্যাপক মোর্শেদ) অপসারণ করার পর একটা চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। আর এ চিঠির নিচে অনুলিপির কথা লেখা আছে। একটা অনুলিপি হলো ডিন- বিজনেস ফ্যাকাল্টি বরাবর, একটা মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান বরাবর আর একটা ডাইরেক্টরস অ্যাকাউন্টস বরাবর। এই চিঠিতে আর কিছু নাই।
তিনি বলেন, মাননীয় উপাচার্য বলছেন, এটা সব জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানে এটা স্পষ্ট যে, এই তিন জায়গা ছাড়া আর কোথাও এই চিঠি দেয়া হয় নাই।
তিনি আরো বলেন, এটা ২০২০ সালের ঘটনা হলেও এই বিষয়ে আর কিছু করা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। পরে চারিদিক থেকে যখন বিষয়গুলো আসছে, তখন আমি স্ব-উদ্যোগে আমার অফিসকে বলছি, এই বিষয়ে খোঁজ নেন। তখন খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এস্টেট অফিসে এই বিষয়ে কোনো কাগজপত্র নেই। তখন ঐ চাকরিচ্যুতির কাগজ নিয়ে আসা হলে আমি নিজে পড়ে দেখলাম, এটার মধ্যে অনুলিপির জায়গায় এস্টেট অফিসের কথা নাই।
অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই বাসা উনাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০১৫ কিংবা ১৬ সালে। কিন্তু আমি কোষাধ্যক্ষ হয়েছি ২০২০ সালে। কাজেই আমার সময়ে যদি এই বাসাটা ক্যান্সেল করতে হয়, তাহলে তো এস্টেট অফিসে চিঠির কপি আসতে হবে। কিন্তু এখানে তা আসে নাই।
ঢাবির কোষাধ্যক্ষ বলেন, এই চিঠির অনুলিপি বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার কথা। এমনকি লাইব্রেরি, মেডিকেল সেন্টারেও যাওয়ার কথা। কিন্তু গেল না! পরে আমি এই ফাইল প্রসেস করেছি। তাতে উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক মোর্শেদ চাকরিচ্যুত হওয়ার পরে আবাসিক ভবনে থাকার কথা নয়। এমনকি ওনাকে বাসা ছাড়ার জন্য সুপারিশও করেছি। মাননীয় উপাচার্যের কাছে এই ফাইল গেছে। কিন্তু উনি এখনো পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেন নাই।
চাকরিচ্যুত শিক্ষক অধ্যাপক মোর্শেদ আবাসিক ভবনে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, আইন মোতাবেক যেভাবে আছে সেভাবে ব্যবস্থা গৃহীত হবে। চাকরি না থাকলে যেভাবে থাকা লাগে সংশ্লিষ্টভাবে অনুসৃত হবে।
উল্লেখখ্য, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেছেন যে, অধ্যাপক মোর্শেদ হাসানের বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে হওয়ায় তিনি বাড়তি সুযোগ ভোগ করছেন।
বিবার্তা/জেএইচ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]