
বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য দিন দিন প্রতিযোগিতা বাড়ছে। দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেও সেই বিষয়ে পেশা বেছে না নিয়ে বিসিএস-এর দিকে ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্ম। চাকরির সুবিধা, সম্মান, নিরাপত্তা, ক্ষমতার প্রভাবসহ নানান কারণে পেশাগত রুচির পরিবর্তন হয়েছে এই প্রজন্মের। এটা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য হতাশাজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পেশাগত রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, বর্তমান শিক্ষা ও চাকরি ব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজালে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
২৭ মে, শুক্রবার ৪৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ১ হাজার ৭১০ ক্যাডার পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭১২ জন প্রার্থী। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছিল ৪১তম বিসিএসে। ওই বিসিএসে ৪ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। ৪৩তম বিসিএসে আবেদন পড়েছিল ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০টি। ৪০তম বিসিএসে আবেদন পড়েছিল ৪ লাখ ১২ হাজার।
গত এক দশকে চাকরিপ্রার্থীদের রুচিসংক্রান্ত একটি জরিপে দেখা যায়, তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের রুচি ও চাহিদা যেন এক বিন্দুতে আবদ্ধ। তা হলো বিসিএস ক্যাডার হওয়া। আরো স্পষ্টভাবে বললে কথিত প্রথম সারির ক্যাডার হওয়া। যেমন- পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন, কর ইত্যাদি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পড়াশোনার গ্রুপগুলোতেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বিসিএস। এসব গ্রুপে স্কুল/কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পরামর্শ চেয়ে পোস্ট দেন। কীভাবে এখন থেকেই তারা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারেন। একই প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাসেও। বিসিএস গাইড নিয়ে শিক্ষার্থীরা ডুবে থাকেন অগ্রিম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। তারা যতটা না পাঠ্যবই বা সাহিত্য পড়তে আগ্রহী, তার থেকেও বেশি আগ্রহী নানা মোড়কের বিসিএস প্রস্তুতির বইগুলো পড়তে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বিবার্তাকে বলেন, ‘রাষ্ট্র্রের জন্য দুভার্গ্যজনক ও হতাশাজনক যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দীর্ঘ শিক্ষা, গবেষণা, যা কিছু শিখে, জীবনে সে আর তা কাজে লাগাবে না। একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, হতাশা ও ক্ষতির বিষয় নেই।’
যেখানে সুযোগ-সুবিধা বেশি, ক্ষমতা বেশি, মানুষ সেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করবে জানিয়ে ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘কিন্তু একজন ভালো অর্থনীতিবিদ যদি ক্যাডার সার্ভিসে যায় তার অর্থনীতির ব্যবহার সে করতে পারবে না। তেমনি একজন রসায়নবিদ যদি ক্যাডার সার্ভিসে যায়, তাহলে রসায়নের ব্যবহার সে করতে পারবে না। তেমনি যে ইংরেজি সাহিত্যের যে সে ক্যাডার সার্ভিসে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের যে জ্ঞান, দক্ষতা কাজে লাগাতে পারবে না। এভাবে বাংলা, ইতিহাস, ম্যানেজমেন্ট বলেন- কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের ক্যাডার সার্ভিসের যে জনবল দরকার সে দক্ষতা দেওয়া হয় না। সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারি না, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।’
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগামের প্রধান শরিফুল হাসান বিবার্তাকে বলেন, ‘বিসিএস থেকে শুরু করে দেশের সরকারি চাকরি যেমন নিরাপদ, তেমনই সকল পেশার সব কাজই নিরাপদ হতে হবে। এমন যদি সব পেশাতে না হয় তাহলে তো সংকট থেকেই যাবে। আমাদের সরকারি চাকরির বেতন, মর্যাদা যেভাবে এগিয়েছে; বেসরকারি খাতে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
একটি রাষ্ট্রের সবাই যদি বিসিএস ক্যাডার হতে চায়- যদি কেউ সাংবাদিক না হয়, লেখক না হয়, শিল্পী না হয়, গবেষক না হয়, বুদ্ধিজীবী না হয়, তাহলে কীভাবে রাষ্ট্র চলবে? একটা রাষ্ট্রে সব পেশার মানুষ যদি না থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্র না রাখাই ভালো বলে মনে করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শরিফুল হাসান। ব্র্যাকে যোগ দেয়ার পূর্বে দীর্ঘ সময় তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বা বিসিএস সংক্রান্ত সংবাদ কভার করেছেন।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘বিসিএস পরীক্ষা যথেষ্ট ফেয়ার। এই সরকারের আমলে ২৮তম বিসিএস থেকে মোটামুটি সব বিসিএস ফেয়ার হয়েছে। তাই গ্রাম-শহরের প্রতিটি ছেলেমেয়ের মনে হয়; আমি যদি সারাবছর পরিশ্রম করি তাহলে হয়তো ভালো একটি সরকারি চাকরি পাব। একদিকে সম্মান, মর্যাদা, আরেকদিকে অর্থ, বিলাসিতা! এজন্যই সবাই বিসিএসের দিকে বেশি ঝুঁকতে চায়।’
বছরে বিসিএস ক্যাডার গড়ে দুই হাজার হয়ে থাকেন, সঙ্গে আরো দুই হাজার নন-ক্যাডার ধরলেও মোট চার হাজার প্রার্থী চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন, বাকিরা তাহলে কী করবেন? এমন প্রশ্ন করে শরিফুল হাসান বলেন, ‘প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে প্রায় ২০ লাখ ছেলে-মেয়ে। তাদের মধ্যে আবার পাঁচ-সাত লাখ শিক্ষার্থী আছে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট করা। কাজেই আমি মনে করি না যে একটা রাষ্ট্রের প্রথম বর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা একাডেমিক পড়ালেখা বাদ দিয়ে শুধু বিসিএসের গাইড মুখস্থ করবে।’
বিসিএস সংক্রান্ত বিষয়ে সময়ের তরুণদের নিয়ে সরকারকে এখনই চিন্তা করতে হবে জানিয়ে ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘যে শিক্ষায় দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, ছাত্ররা যে জ্ঞান অর্জন করছে, সেই জ্ঞান দিয়ে তারা রাষ্ট্রের বা জাতির কোনো উপকারে আসছে না। বরং এটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখালাম রসায়ন, পদার্থ, গণিত, ইতিহাস, ইংরেজি, বাংলা। এটা কিন্তু ইন্টারমিডিয়েটের কোনো বিষয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয়ে দীর্ঘ চার বছর পড়ানো হয়, তাকে ওই বিষয়ে স্পেশালাইজড হতে। তার জ্ঞান, দক্ষতা সে কীভাবে ব্যবহার করবে, তার কোনো সুযোগই নাই। কারণ আমরা তাকে ভূমি অফিসার বানিয়ে দিয়েছি, অথচ একজন ভূমি ক্যাডার হওয়ার আগ পর্যন্ত সে ভূমি বিষয়ে কিছুই জানত না।’
ড. কায়কোবাদ বলেন, ‘একজন প্রকৌশলী যদি মনে করে, কত কষ্ট করে অনেক মেধাবীদের পেছনে ফেলে বুয়েটে সে ভর্তি হয়েছে। কত মেধাবীরা তার ওই বিষয়ে ভর্তি হতে পারে নাই। লাখ লাখ শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নাই। অথচ সে ভর্তি হবার পর দেখল প্রকৌশলী হয়ে তার জীবনের মান যা হবে, তার থেকে একজন ক্যাডার হতে পারলে জীবনের মান আরও উন্নত হবে। সে যদি ভূমি অফিসার হয়, ক্যাডার সার্ভিসে আসে। যেমন জীবনের মান উন্নত হবে, সমাজ তাকে সম্মান করবে, সমীহ করবে, তার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকবে, অনেক ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করতে পারবে। সে একটা ট্রেনকে থামিয়ে দিতে পারবে, সে আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রাখতে পারবে! কারণ আমার আসতে বিলম্ব হচ্ছে।’
এখন এসব চিন্তা করে স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রকৌশলী বা ডাক্তার ক্যাডার হতে চাইবেন বলে মনে করেন ড. কায়কোবাদ। তিনি বলেন,‘তারা কেনো পিছিয়ে থাকবেন। প্রকৌশলী বলবে আমি পিছিয়ে থাকব কেন, ডাক্তার বলবে আমি পিছিয়ে থাকব কেন। অথচ জাতির যে এত অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা মেটানো সম্ভব না।’
এই পরিস্থিতি একটা রাষ্ট্রের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে না, ক্লাসের প্রতি কোনো মনোযোগ নাই। এখানে কিন্তু শিক্ষার্থীদেরও দোষ দেওয়া যাবে না, কারণ সে জানে না অন্য কোনো চাকরি পাবে কিনা? এই অনিশ্চয়তায় সে বিসিএস দিচ্ছে। আবার যাদের বিসিএস হয় তারা ভালো থাকে, আর যাদের হয় না তাদের একটা বড় অংশ আবার হতাশায় ভোগে। দেখা যায়, যার বয়স ত্রিশ হয়ে গেছে অথচ বিসিএসের পড়ালেখায় সাত-আট বছর পার করেছেন। বিসিএস এর পেছনে সময় না দিয়ে ভালো কিছু করতে পারতেন। সমস্ত কিছু মিলিয়ে আমি যদি বলি একদিকে বিসিএস অন্যদিকে সবকিছু। যার কারণে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থার তৈরি হয়েছে, যেটা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক না।’
পুরো বিষয়টি নিয়ে আমাদের আলোচনা করে ভাবার ও চিন্তার সুযোগ আছে। এখানে কাউকে দোষারোপ করার চেয়েও আমাদের সবাইকে মিলে সংকটের সমাধান করাটা বেশি জরুরি বলে মনে করেন শরিফুল হাসান।
এজন্য করণীয় কী হতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শরিফুল হাসান বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত চাকরিতে এমন পার্থক্য না কমবে, এর থেকে বের হবার তেমন সুযোগ নেই। সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের দিকে নজর দেয়া, ঠিকমত যেন সেটা গ্রো করে। সবকিছুর নিয়ম-নীতি তৈরি করে দেয়া। বেসরকারি খাতের লোকজন ও উদ্যোক্তাদের বুঝতে হবে এবং গ্রো করতে হবে। সামগ্রিকভাবে আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরিব্যবস্থা, তা নিয়ে কাজ করা উচিত। কারণ আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্য ছিল কর্মচারী তৈরি করা। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রসঙ্গ টেনে ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আমরা জানি আমাদের ক্যাডার সার্ভিসের লোকজন ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও যথেষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। আজকের পেপারেই দেখলাম একজন সিনিয়র সচিব অবসরে যাবার আগমুহূর্তে ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নিলেন। এখন এই প্রশিক্ষণ কার কাজে লাগবে। সরকারের এত টাকা অপচয় করলেন, তাতে কি লাভ হলো। অবশ্যই প্রশিক্ষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনে যে জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি লাগে, এটা ডেভেলপ করার জন্য তাদের আলাদা প্রশিক্ষণ দরকার।’
‘এমনটা হতে পারে যে, প্রশাসন ক্যাডারে যাওয়ার জন্য আলাদা একটা বিভাগ থাকবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারে, তাদের রসায়ন, পদার্থ, গণিত জানতে হবে না, তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। তারা শিখবে ভূমি সংক্রান্ত যত ঝামেলা ও সমস্যা। কারণ তাদের এ সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবেলা করতে দক্ষতা বাড়াতে হয়। ক্যাডাররা যদি বিদেশে আমাদের দূতাবাসে চাকরি করে, তাহলে দেশের প্রতি একটা মমত্ববোধ থাকতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যে সমস্ত মানুষ সমস্যায় পরে আন্তরিকতার সাথে সমাধান করতে হবে। তাদের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য, গণিত, ম্যানেজমেন্ট, সমাজবিজ্ঞানের কোনো জ্ঞান, দক্ষতা অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিতে একজনেরও নেয়ার কোনো দরকার নাই। কারণ, এগুলো তাদের চাকরিতে নাই’, যোগ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
অন্যদিকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে ভালো মানুষ তৈরি করা, যারা সকল কাজে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন বলে মনে করেন শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা এখনও তা করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা হয়ে গেছে চাকরি নির্ভর। পুরো ব্যবস্থায় আমরা যতক্ষণ না হাত দিব আমাদের একেবারে শিক্ষা, চাকরির পেশায় ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে যদি সমন্বয় না করতে পারি, তাহলে লাভ হবে না।’
বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]