তিন ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান এক মসজিদ
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৫৯
তিন ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান এক মসজিদ
ধর্ম ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ তিন ধর্ম খ্রিষ্টান, ইহুদি এবং ইসলামের অনুসারীদের কাছে প্রিয় আল আকসা। মক্কা-মদিনার পর মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান এটি। ইহুদিরা মনে করেন এটি ‘টেম্পল মাউন্ট’। তাদের বিশ্বাস, ইহুদি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইবরাহিম আ. তার পুত্র ইসমাঈল আ.-কে উৎসর্গ করার জন্য এখানেই নিয়ে এসেছিলেন। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এটাই সেই জায়গা যেখানে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানকার গুহাতেই তার দেহ রাখা হয়েছিল।


আল আকসা মসজিদ কোনো একক মসজিদ নয়। আল আকসা মসজিদের এরিয়ায় রয়েছে কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ- যাকে কুব্বাতুস সাখরা বলা হয়। আরেকটি মসজিদ হলো বুরাক মসজিদ। এই তিন মসজিদের সমন্বয়ে আল আকসা কম্পাউন্ড।


ইসলামের প্রথম যুগে মসজিদুল আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা নামাজ আদায় করেছেন দীর্ঘ ১৬ মাস। এ মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাসুল সা. এর পবিত্র মেরাজের স্মৃতি। মসজিদুল আকসাকে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বরকতময় ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা বনি ইসরাইল, সুরা মায়েদা, সুরা আম্বিয়া, সুরা আরাফ, সুরা সাবার মোট ৬টি আয়াতে মসজিদুল আকসাকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলেন, পবিত্ৰ মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করালেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশকে আমি করেছি বরকতময়, যেন আমি তাকে আমার নিদর্শন দেখাতে পারি; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। (সুরা বনি ইসরাইল আয়াত ১)


এ মসজিদে নামাজ আদায়ের বিশেষ ফজিলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। রাসুল সা. বলেন, ‘মসজিদে হারামে এক নামাজ এক লাখ নামাজের সমান, আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক নামাজ এক হাজার নামাজের সমান আর মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাসে এক নামাজ ৫০০ নামাজের সমান।’ (মাজমাউজ যাওয়াইদ ৪/১১)


এদিকে এখানেই ছিল ইহুদিদের প্রথম ও দ্বিতীয় উপাসনালয়, যা ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র স্থান আল আকসা। যুগ যুগ ধরে তাই এ এলাকা ঘিরেই চলছে সংঘাত। বলা যায়, ঐতিহাসিকভাবে এটি বিবাদের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।


ইসরাইলি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী নানা বিধিনিষেধ ও শর্ত পূরণের মাধ্যমে শুধু মুসলিমরাই আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকে প্রার্থনা করতে পারেন, নামাজ আদায় করতে পারেন। অন্যদিকে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা আল আকসায় শুধু পর্যটক হিসেবে প্রবেশ করতে পারবেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন তাদের জন্য আল আকসা খোলা থাকে। দিনে চার ঘণ্টা সময় পান ওই এলাকা ঘুরে দেখার জন্য।


খ্রিস্টান ও ইহুদিরা আল আকসায় প্রবেশ করে প্রায়ই তাদের ধর্মীয় ইবাদতে লিপ্ত হন। মুসলিমদের নামাজ আদায়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। তখন ইসরাইলি নাগরিক এবং সেনাদের সঙ্গে মুসল্লিদের সংঘাত বেধে যায়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিলো ছোটখাটো সংঘাত।


খ্রিস্টানরা যদিও যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি আল আকসায় ঘটেছে বলে দাবি করেন, এ সংক্রান্ত প্রায় সব প্রাচীন উৎস পুঁথিগত। এর কোনো ভিত্তি নেই বললেই চলে। তবে ১৯৬৮ সালে জেরুজালেমের উত্তরপূর্বাঞ্চলে প্রথম শতাব্দীতে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এক ব্যক্তির কথা প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন রোমান যুগে ক্রুশবিদ্ধকরনের ঘটনা ঘটেছিল, তার ধরণ বাইবেলের সুসমাচারে বর্ণনা করা যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরনের সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণ মিলে যায়। এ জন্য খ্রিস্টানরা মনে করেন, এখানেই যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে (উইকিপিডিয়া)। যদিও কোরআনের ভাষ্যমতে ঈসা আ. কে আল্লাহ তায়ালা উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে আগমন করবেন।


প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে তাইমিয়ার মতে, হজরত সুলায়মান আ. এর তৈরি করা গোটা স্থানটির নামই হল মসজিদ আল-আকসা। বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বোখারিতে বর্ণিত, হজরত আবু জর গিফারি রা. এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটি সর্ব প্রথম আদম আ. তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল পৃ‌থিবীর দ্বিতীয় মস‌জিদ। রাসুল সা. কে জি‌জ্ঞেস করা হ‌য়ে‌ছে বায়তুল্লাহ নির্মা‌ণের কত দিন পর আল আকসা নির্মাণ করা হ‌য়? তি‌নি বলেন, চ‌ল্লিশ বছর পর। (বোখারি হাদিস ৫৮৫)


কোরআনের বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থের ভাষ্যমতে আল আকসা নির্মাণের পর থেকে শত শত নবী সেখানে অবস্থান করেছেন। হজরত ঈসা আ. (খ্রিস্টধর্মে যিশু)সহ অনেক নবীর বাসস্থান ছিলো এ আকসা। কালের আবর্তে হজরত ইব্রাহিম আ. নির্মিত আল আকসা বহুবার সংস্কার হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব আগেকার আদলে বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি ছোট মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয় অনেক বড় আকারে। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়।


৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংস হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমি খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন, যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।


এখন যে মসজিদটি আছে, তা নির্মিত হয়েছে ১০৩৫ সালে। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা মসজিদটি দখল করে গির্জায় পরিণত করে এর একটি অংশকে। তাদের দখলে ৮৮ বছর থাকার পর ১১৮৭ সালে গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ. খ্রিস্টানদের হাত থেকে আল-আকসা উদ্ধার করেন।


১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেয় তারা। এরপর থেকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দখলদার ইসরাইল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আল-আকসা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। এমনকি ১৯৬৯ সালে পবিত্র মসজিটিতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এরপর নানা বিধিনিষেধ আর শর্তসাপেক্ষে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা।


পরে আবারও বিভিন্ন অজুহাতে ইসরাইলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরাইল। সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই আসছে। মুসলিমদের পুণ্যভূমি আল আকসা আর মুসলিমদের হয়ে ওঠেনি।


হজরত নাউওয়াস ইবনে সামআন রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে। ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’


দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার এক পর্যায়ে নবী করিম সা. বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনে মারিয়াম আ. কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে, আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে খুঁজতে থাকবেন। শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৯৩৭)


আগের মুলকে শাম বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিস্তৃত রয়েছে। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কিয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. শামের ব্যাপারে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এ হাদিসের মাধ্যমে বুঝা যায়, ফিলিস্তিনের কোনো এলাকাতেই ঈসা আ. আগমন করবেন।


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com