শিরোনাম
ধর্মের সৌন্দর্যই সম্প্রীতি
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৪৩
ধর্মের সৌন্দর্যই সম্প্রীতি
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

ধর্মীয় উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান’ কবিতায় বলেছেন-


‘মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’


তিনি আরো বলেছেন ‘সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম৷ যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব৷ আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি৷ (প্রতিভাষণ: নজরুল ১৯২৯)।


জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি লিখেছেন,


‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।
গাহি সাম্যের গান!’


আরো লিখেছেন-


‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’


দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে প্রতিবারেই সারাদেশে আনন্দঘন আবহের সৃষ্টি হয়। এবারও দেশব্যাপী বইছে নির্মল সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত উৎসবের ফল্গুধারা। ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৈসবী উৎসব, বৌদ্ধ পূর্ণিমা সব মিলেই এদেশের মানুষের আনন্দ।


মহাত্মা গান্ধীকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়- তিনি হিন্দু কিনা- তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাই। এ ছাড়াও আমি একজন খ্রিস্টান, একজন মুসলমান, একজন বৌদ্ধ এবং একজন ইহুদি।’


আবার লালন শাহের ভাষায়-


‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।’


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারন করতেন, তিনি হিন্দু-মুসলিম কাউকে আলাদা করে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।’


যুগ যুগ ধরে এই বাংলায় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সব ধর্মের মানুষ এক সাথে মিলেমিশে জীবন যাপন করছে, নিজ নিজ ধর্মের উৎসব পার্বণের আনন্দ একে অন্যেও সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। নানা ধর্মের এমনই সব বর্ণিল পার্বণের মাঝে জীবন চলে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাধারণত দু’টি রূপ লক্ষ করা যায়। একটি অংশ হচ্ছে ধর্মীয় আচার, আরেকটি অংশ সামাজিক আচার। এই সামাজিক অংশটুকু ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমা ছেড়ে সমাজের সকল মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আনন্দের। সমাজের সকলকে নিয়ে আনন্দ করার মাঝে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত উৎসবের আমেজ। ধর্মের এই সার্বজনীন অংশটুকুই সমাজের সকল মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে ভিন্ন এক আবহ। আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’


ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসবের অংশটুকু প্রকৃতপক্ষে সমাজকে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে। সমাজে সৃষ্টি করে সম্প্রীতির বন্ধন। যার মূল কথা সমাজের মধ্যে প্রেম-মৈত্রী ও শান্তি। আবহমানকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে বসবাস করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। সৌহার্দপূর্ণ অবস্থানের জন্য ধর্ম কখনই প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি। ধর্মের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বিভেদের রেখা টানা শুরু করে ব্রিটিশ শাসকরা। ব্রিটিশ শাসকেরা ধর্ম- হিন্দু ও মুসলমান, তারা কোনটিতেই বিশ্বাসী ছিল না। তবুও এই বিষয়টিকে সামনে টেনে এনে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা। সে সময় থেকেই মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। তারপরও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিভেদ তেমন রেখাপাত করতে পারেনি।


হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। ব্রিটিশদের কূটরাজনীতির কারণে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। যার পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়। তবে ভারত বিভক্তির ঘটনাটি ঘটে বৃটিশদের সৃষ্ট সেই ধর্মীয় বিভেদের সূত্র ধরেই। অথচ ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ধর্ম কখনই বিবেচ্য বিষয় ছিল না। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এখানে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ধর্মের বিশ্বাসে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন চলেছে ধর্মের বিশ্বাসের বাইরে। প্রকৃত রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের ক্ষেত্রে ধর্ম কোন বিবেচ্য বিষয় না, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল মানুষের অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অংশগ্রহণের স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে গেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সকল মানুষ মরনপণ যুদ্ধ করেছে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মত রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের প্রাধান্য পাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়ে।


স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানও সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্থান পেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বর্তমান সময়ে সেই সম্প্রীতিতে আঘাত বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। যাকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলে থাকি। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ আলাদা। সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে পশুতে পরিণত করে। মানুষের সাথে মানুষের সম্মান ভালোবাসাকে আঘাত করে। এই সাম্প্রদায়িকতার কারণে বর্তমান বিশ্বে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এই উপমহাদেশে অনেক বার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয় রাজনৈতিক শঠতার কারণে।


স্বাধীনতার চেতনায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে সেটিও পরিবর্তিত হয়ে যায় ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, রাজনৈতিক অসততার কারণে। এ কারণে বেশ কয়েক বছর কিছু ঘটনা এ অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ম্লান করে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও প্রতিমা ভেঙে ফেলার মত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে কোথাও মন্দিরে কোরআন রেখে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব ঘটনার পেছনের হোতা। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবেই দেখতে চাই। তারপরও যখন গণমাধ্যম বা সামজিক


যোগাযোগ মাধ্যমে এমন সংবাদ আসে তখন কষ্ট লাগে। যারা এসব ঘটনার পেছনের কুশীলব, খোঁজ নিলে দেখা যায় তারা নিজেরা কখনও ঠিকমত নিজের ধর্ম পালন করে না। এরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না। কিন্তু অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের নিজের অশুভ চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়। এসব অপকর্মের পেছনে ভয়-ভীতি দেখিয়ে সম্পদ গ্রাস করাই থাকে তাদেও মূল লক্ষ্য। অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে বাঁধা সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক


উদ্দেশ্যও নিহিত থাকে। এক শ্রেণির রাজনীতিকের কারণে বা কিছু অতিলোভী মানুষের সম্পদ দখলের মানসিকতার কারণে হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এটাই হচ্ছে কুপমণ্ডুকতা।


হিন্দু ধর্মালম্বীদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এ পূজায় প্রতিমা তৈরি, তাতে পূজা দেওয়া বা প্রতিমা বিসর্জন এসব হচ্ছে যারা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী তাদের জন্য। কিন্তু এ পূজাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব যেমন- নাচ, গান, বাজনা, প্রসাদ বিতরণ বা মজাদার খাবার বিতরণ সেটি কিন্তু সকল ধর্ম-বর্ণ মিলে উপভোগ করে থাকে। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই উপভোগ করে। এটাই ধর্মের সামাজিক রূপ নিহিত- যা সামাজিক সম্প্রীতি ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হওয়ার মন্ত্র। এই মন্ত্রই পারে আমাদের দেশে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে দেশকে এগিয়ে নিতে।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com