রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়া প্রবাসীদের অধিকার, সুযোগ নয়
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩, ১৯:১১
রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়া প্রবাসীদের অধিকার, সুযোগ নয়
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ মেয়াদে ২৪তম প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীর পেশ করা ৫ম বাজেট এটি।


২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বড় অংকের বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এরপরও ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।


এবারের বাজেটে প্রবাসীদের বড় দুইটি আশার বাণী শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে প্রবাসীরাও যুক্ত হতে পারবেন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রবাসীদের স্মার্ট কার্ড প্রদানের জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্ধ। যদি সেই স্মার্ট কার্ড প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় তাহলে নানা রকম হয়রানি থেকেই প্রবাসীরা মুক্তি পেয়ে যাবেন। এর বাইরে আসলে উল্লেখ করার মতো আর কিছু নেই।


অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন , প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের বেশি বয়স পর্যন্ত একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর পর্যন্ত চাঁদা দিলে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। কিন্ত সেই পেনশনের পরিমাণ কী? কিংবা ১০ বছর সেই পেনশনের জমা দেয়ার পরিমাণ কত হতে হবে সেটি বিস্তারিত জানা যায়নি। আর পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছরের আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি বাকি সময়ের পেনশন পাবেন। এ ছাড়া চাঁদা দেওয়ার ১০ বছরের মধ্যে কেউ মারা গেলে জমাকৃত টাকা মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।


বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যানুপাতে রেমিট্যান্স আহরণের গতি ততটা সন্তোষজনক নয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কর্মীদের প্রাক-বহির্গমন অবহিতকরণসহ বিভিন্ন কারিগরি কোর্সে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। টিটিসিগুলোতে জাপানি, ইংরেজি, কোরিয়ান, চাইনিজ ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করেছি। প্রশিক্ষণের গুণগতমান নিশ্চিতকরণ, দক্ষতার স্বীকৃতি, দক্ষ পেশায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, স্থানীয় প্রশিক্ষণ সনদের আন্তর্জাতিক সনদায়ন নিশ্চিতকরণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জনসহ নানাবিধ কার্যক্রম আমরা অব্যাহত রেখেছি। বিদেশগামী প্রত্যেক কর্মীকে মাইক্রোচিপস সম্বলিত স্মার্ট কার্ড/ বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অদক্ষ ও আধা-দক্ষ ক্যাটাগরিতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ পেশাদার হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে।


বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসীরা সোনার ডিমপাড়া হাঁস। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন প্রবাসীরা সর্বোচ্চ। আর সেবা প্রাপ্তিতে তাঁদের অবস্থান সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যার মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের মতো। অভিবাসীদের বড় অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। যেসব ১০টি দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য।


এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ এসেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দেশের বাইরে থেকে আসা বাৎসরিক গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। করোনার এই সংকটকালেও প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করেনি। করোনাকালে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে প্রবাসী কর্মীরা।এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে ও বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার মূল কারণ প্রবাসী আয়।


অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছেন, নিরাপদ অভিবাসন ও প্রবাসীদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করা হচ্ছে। প্রবাসী ও প্রত্যাগত কর্মীদের জন্য বীমা, প্রবাসে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, তাদের মেধাবী সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, অক্ষম প্রবাসী কর্মীদের চিকিৎসার্থে অর্থ সহায়তা এবং অনলাইন অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাসহ বহুবিধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রবাসী কর্মীগণের ন্যূনতম খরচে বিদেশ গমন এবং প্রত্যাগমনকালে সাময়িকভাবে অবস্থানের জন্য নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার’ এর মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।কিন্ত বাস্তব চিত্র কি আসলেই এতো সুন্দর? আসলে, 'কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই'


প্রবাসীরা বাংলাদেশে সেবা নিতে গিয়ে সর্বোচ্চ হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এখনো বহু দেশ থেকেই প্রবাসীদের চাঁদা তোলে দেশে লাশ পাঠাতে হয়।


কিন্তু প্রবাসীদের প্রত্যাশা কী? প্রবাসীরা আসলে কি আর্থিক সহযোগিতা চায়? আমার মনে হয় সেই সংখ্যা খুবই নগণ্য। আর্থিক সেবা বা নাগরিক হিসাবে পেনশন সুবিধাসহ রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। সকল নাগরিকের সমান অধিকার। সেই রাষ্ট্রীয় সেবা ভোগ করা তাঁর অধিকার, সেটি কোনোভাবেই সুযোগ নয়।


প্রবাসীরা চায় সেবা। সেই সেবার মান এবং সেবা পদ্ধতি যত বেশি প্রবাসী বান্ধব হবে প্রবাসীরা তত বেশি খুশি হবেন। কারণ এই বিশাল প্রবাসীদের ৯০/৯৫ ভাগই বিদেশে গেছেন তাঁদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। সরকারি সহায়তা সেখানে খুব সামান্যই ছিল। আর সরকারিভাবে বিদেশে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা হাতেগোনা।


তাই প্রবাসীরা যে সেবাসমূহ সবচেয়ে জরুরি এবং সেসব সেবা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী প্রবাসীরা সেইগুলো চিহ্নিত করে এর পদ্ধতিগত পরিবর্তন করা জরুরি। প্রবাসীদের চেয়েও জরুরি সেবাদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি।


প্রথমত আমাদের মিশনগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের অফিসার সুলভ আচরণের কারণে সাধারণ প্রবাসীদের কাছে তারা এক আতংকের নাম। তারা সাধারণ শ্রমিকদের সাথে বা সাধারণ মানুষের সাথে খুব বেশি সহজ আচরণ করেন না। এই অভিযোগ বহির্বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দূতাবাসে।


প্রবাসীদের যে সব অতি জরুরি বিষয় থাকে সেসবের মধ্য উল্লেখযোগ্য পাসপোর্ট তৈরি ও নবায়ন। জন্মনিবন্ধন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, বিমান টিকেট ও বিমান বন্দরে হয়রানি।


এক পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিয়ম কানুনের বেড়াজালে প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন সরকারের উপর। কারণ মিশনগুলো বলছে সরকারি নির্দেশ বা ঘোষিত অধ্যাদেশের কারণে তাদের এই নীতি প্রয়োগ করতে হচ্ছে। পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের এয়ার টিকেটের চেয়ে বিমানের টিকেটের দাম সবসময় বেশি হয়। তবু মানুষ বিমানই চড়তে চায়,কিন্ত সেবার মান নিয়ে সব সময় অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন প্রবাসীরা। বিমানের টিকেট অন্য এয়ারলাইনের সাথে প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে নির্ধারণ করলে বিমান হতে পারত সবচেয়ে লাভবান একটি খাত। আর বিমানবন্দরে হয়রানি সে প্রতিটা প্রবাসীর ললাট লিখন। দ্বিতীয় যে সেবাটি দেশে প্রবাসীদের খুবই জরুরি সেটি হচ্ছে সহজ ব্যাংক লোন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের যে সমস্যা হয় দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার কারণে, দেশে অবস্থানকালীন সময়ে হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলে, অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পরেন। হয় চড়া সুদ অথবা স্ত্রী কন্যার সোনাদানা বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে আসেন। এই ক্ষেত্রে প্রবাসী ব্যাংক অথবা অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সহজ শর্তে বা নিয়মে ঋণের সুযোগ করে দেয়া। ঐ প্রবাসীর বিদেশে ভিসার মেয়াদ এবং দেশে টাকা পাঠানোর প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ঋণ দানের সুযোগ থাকলে প্রবাসীদের দেশে অবস্থানকালীন সময়টুকু আনন্দের হবে।


আমার সর্বশেষ অভিজ্ঞতা হল, আমার ২০১৯ সালে আমার স্ত্রী যখন লন্ডনে আসবেন, ইমিগ্রেশন থেকে আমার স্ত্রী আমাকে ফোন দিলেন, আমার পাসপোর্টের কপি পাঠাতে। আমি বললাম আমার পাসপোর্ট দিয়ে কী হবে? দায়িত্বরত কর্মকর্তা আমার স্ত্রীর কাছে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট চাইলেন। যা নাকি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নিতে হয়। উনি স্বামীর কাছে যাচ্ছেন তার অভিভাবক নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিবেন জেলা প্রশাসক বা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে! তারপর আমি লন্ডনে কী করি সেই চাকরির প্রমাণপত্র চাইলেন।


একজন মানুষ তার পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসী হচ্ছে এই মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তা তো আমরা জানি। আমি সরাসরি ঐ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানতে চাইলাম, আমার পাসপোর্টের সাথে আপনার সম্পর্ক কী, যে যাত্রী তার ভিসা-পাসপোর্ট ঠিক থাকলে, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলে তাকে আপনি আটকাতে পারেন না। আমি কিছুই দিব না। আপনি যতক্ষণ পারেন তাকে আটকে রাখেন। যাই হোক প্রায় আধাঘণ্টা তারা আমার স্ত্রীকে সেখানে লাইন থেকে নিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন। যদিও পরে বিমানের সময় হয়ে যাওয়াতে তাকে ছেড়ে দেয়। তাও লাগেজ সহায়তায় জন্য বখশিশ দিয়ে আসতে হয়েছিল।


এরচেয়েও বাজে অভিজ্ঞতা হয় প্রবাসীদের, দেশে ফেরার সময়। যার নাম লাগেজ বিড়ম্বনা। শখ করে৷ আপনজনদের জন্য নানারকম সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে যান অনেকে। সেসব নিয়েও নানারকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের।


বাজেটে প্রবাসীদের জন্য কি বরাদ্দ আছে, জি নেই, আদৌ প্রবাসীরা এসব নিয়ে ভাবেন না। তারা জানেন দিনশেষে তাদের অর্জিত পাউন্ড ডলার রিয়াল দেশে পাঠাতে হবে। তাই সরকারের উচিত প্রবাসীদের সেবার মান নিশ্চিত করা, বিদেশে যখন আসেন ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করে নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে মাথা নিচু করেই সেই দেশের অভিবাসন গেইট দিয়ে প্রবেশ করেন। কিন্ত দেশে ফেরার সময় যেন হাসিমুখে মাথা উঁচু করে কোনো ধরণের হয়রানি ছাড়া পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারেন সেইটুকু নিশ্চিত করতে হবে।


লেখক : সম্পাদক ব্রিকলেন। যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com