কেমন হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৭
কেমন হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ
এম. রাশিদুজ্জামান
প্রিন্ট অ-অ+

ইতিহাস জুড়েই সভ্যতার উত্থান হয়েছে নগরকেন্দ্রিক। কেননা নগরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জীবনমান ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বেশি থাকায় অধিকাংশ মানুষই নগরমুখী। নবপ্রযুক্তির এ যুগেও উদ্ভাবনী উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় নগরগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কোনো ভৌগলিক সীমানা থাকবে না। একটি বৈশ্বিক চরিত্রই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সৃষ্টি করেছে, তাই সেখানে শিল্প উৎপাদনের কোনো নির্দিষ্ট স্থান থাকবে না। কর্মীরা কোথায় আছে সে প্রশ্নও থাকবে না। তাই একটি দেশের জনগণ সেখানেই থাকতে চাইবে, যেখানে নাগরিক সুবিধা সর্বোচ্চ থাকবে।


নাগরিক সুবিধা নিশ্চত করতে নগরকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যেখানে একজন নগর পিতা দেশ-বিদেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হবে। পুরো বাংলাদেশকে একটি নগর হিসেবে চিন্তা করেই ক্লাউস শোয়াব ঘোষিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রেশ ধরে স্মার্ট নগরের ন্যায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ২০ কোটির অধিক জনসংখ্যা বসবাস করবে। এই বিপুল জনসংখ্যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, তাদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট বের করে আনা এবং দক্ষতার বলে বিশ্বের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে যাবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। কেননা যেসব দেশ এই নতুন ডিজিটাল অর্থনীতি অর্থাৎ ফিফথ জেনারেশনের ইন্টারনেট, বাণিজ্যিকভাবে ড্রোন এবং রোবটের ব্যবহার, ইন্টারনেট অব থিংস, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এবং উৎপাদন ব্যবস্থার অটোমেশনকে গ্রহণ করবে তারা নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাবে।


স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে এমন বৈশিষ্ট্য সংবলিত দেশ বোঝায় যেখানে আইসিটি এবং আইওটি ব্যবহার করে এমন একটি নগরায়ন সিস্টেম সংঘটিত হবে যেখানে সম্পদ এবং সম্পত্তি সঠিক ও কার্যকরভাবে নাগরিকদের জন্য ব্যবহার করা হবে। বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত মেকানিক্যাল ডিভাইস এবং নাগরিকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ডেটা প্রসেস এবং এনালাইসিস করে নগরের সমস্ত যানবাহন, পরিবহন সিস্টেম, পাওয়ার প্লান্ট, পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন ইত্যাদি নাগরিকদের অনুকূলে অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যবহার করা হবে। একটি স্মার্ট সিস্টেম গড়ে তোলার উদ্দেশ্যই হলো পরিবেশের ক্ষতি না করে, খরচ কমিয়ে এনে নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি করা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে আর্থসামাজিক এবং নগরের বাস্তুগত প্রতিবন্ধকতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। স্মার্ট বাংলাদেশকে আমরা সাসটেইনেবল বাংলাদেশও বলতে পারি। বিশ্বের দিকে তাকালে কয়েকটি স্মার্ট সিটি যথা সিঙ্গাপুর, বার্সেলোনা, সানফ্রান্সিসকো, লন্ডন, অসলো শহরগুলোর আদলে বাংলাদেশের নাগরিক সেবা ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা হবে।


স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে স্মার্ট ইকোনমি। কারণ অর্থনীতির উপরই নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের বক্তৃতায়ও স্মার্ট ইকোনমির কথা উল্লেখ করেছেন। স্মার্ট ইকোনমি হলো প্রযুক্তিনির্ভর এমন একটি অর্থনীতি যেখানে দেশের সম্পদ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। স্মার্ট ইকোনমি নতুন উদ্ভাবনকে যেমন যথাযথ সম্মান জানাবে ঠিক তেমনি যেকোনো নতুন উদ্যোগ, উৎপাদন ও প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করবে। অর্থনীতি প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় সেবাদাতা ও সেবাগ্রহিতা সকলেই তথ্য জানতে পারবে বিধায় স্বচ্ছতাও থাকবে অতি উচ্চ। পাশাপাশি স্মার্ট গভর্নেন্স থাকার ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমে কাজের গতি ও প্রান্তিক পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।


স্মার্ট নগরীতে ইন্টারনেটের ন্যায় দেশে পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত পাইপলাইনেও আইওটির প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা যাবে কোন এলাকায় পানি প্রবাহ কতটুকু এবং প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। চাহিদা ও প্রয়োজন বিবেচনা করে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা হবে এবং শহরগুলোর বর্জ্যগুলো নেটওয়ার্কিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে সময়মত পরিচ্ছন্ন করা হবে।


চলাফেরার রাস্তায় সেন্সর থাকবে এবং আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহারে দূরনিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। ফলে রাস্তাঘাটের দুর্ঘটনা কমবে, ট্রাফিকজ্যাম কমবে এবং গণপরিবহন ব্যবহারে সাধারণ মানুষ উৎসাহ পাবে। একইসাথে ইলেকট্রিক গাড়ি, রোবটিক গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহ যোগানো হবে এবং নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রিত পার্কিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে যাতে নগরীর দূষণ কমানো সম্ভব হবে। শহরে লাগানো ক্যামারা এবং সেন্সরগুলো গণপরিবহন এবং ট্রেনগুলোকে প্রয়োজনমত সিগন্যাল দিবে, দেখিয়ে দিবে কোন রাস্তায় কত ট্রাফিক, কত মানুষের ভীড়। গণপরিবহনে ই-টিকেট, সিট বুকিং ছাড়াও পরিবহনের অবস্থান জানার জন্য সর্বাত্মক ট্র্যাকিং করা হবে।


আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং আইওটি প্রযুক্তি শহরের রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে সংযুক্ত থাকবে। এর ফলে এই ল্যাম্পপোস্টগুলো শুধু আলোই দেবে না, সাথে সাথে আবহাওয়া, পরিবেশের দূষণ মাত্রা, ভূতাত্তিক তথ্য, ট্রাফিকের গতি, পথচারীদের চলাফেরা, হইচইয়ের মাত্রা ইত্যাদির তথ্য পরিবেশন করবে, যাতে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহজে ও দ্রæত সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেন।


চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় প্রভাবান্বিত করবে কৃষি, গবাদীপশুসহ অন্যান্য উৎপাদনেও। যেমন ধরা যাক, গবাদী পশু বা পাখি উৎপাদনের সময় প্রত্যেকটার সাথে সেন্সর লাগানো থাকবে। এই সেন্সর মোবাইল নেটওয়ার্কের সাহায্যে এসব পশু-পাখির স্বাস্থ্য ও প্রয়োজন সম্পর্কে রিয়েল টাইম ডেটা পাওয়া যাবে এবং সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।


স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও তার গতি সর্বত্র থাকার ফলে বাসাবাড়িতেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে। শুধু বিনোদন ও যোগাযোগের মাত্রা ছাড়িয়ে হোম অটোমেশন হয়ে যাবে, যার ফলে লাইট নিয়ন্ত্রণ, এসি নিয়ন্ত্রণ, বায়ু নিয়ন্ত্রণ, অডিও-ভিডিও নিয়ন্ত্রণ, এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং এডভান্স রোবটিক টেকনোলজি উন্নয়নের ফলে বাসাবাড়ীর অনেক কাজ যেমন ঝাড়– দেওয়া, ঘর মোছা বা আরও অনেক কাজ রোবটের দ্বারাই করানো সম্ভব হবে।



আমাদের প্রাত্যহিক লেনদেনেও আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাংলাদেশে লেনদেন হবে ক্যাশলেস। বিকাশ বা নগদের মত মোবাইল লেনদেন প্রযুক্তি উন্নয়ন করবে, আরও গ্রহণযোগ্য হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেম পুরোপুরি অটোমেটেড হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির প্রভাবে ক্যাশলেস লেনদেন হবে সর্বত্র। এমনকি প্রত্যেক মানুষেরই আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত নতুন পরিচিতি হবে। এই নতুন পরিচয়ের মাধ্যমেই সকল লেনদেন করা যাবে, সরকারি যাবতীয় সুবিধা গ্রহণ করা যাবে। পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মত কাজগুলোও এই নতুন পরিচিতির মাধ্যমেই সম্পন্ন করা যাবে।
আগামির বিশ্বে যেহেতু কর্মীদের কোন সীমারেখা থাকবে সেহেতু দেশে থেকেই একজন কর্মী বৈদাশিক মুদ্রা অর্জনে সার্থক ভূমিকা রাখতে পারবে। ইতোমধ্যেই ফ্রিল্যান্সিং-এর মাধ্যমে বৈদাশিক মুদ্রা অর্জনের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই এর পরিধি আরও বাড়বে যদি যুগোপযোগি দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা যায়। স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেট গতি যেমন বাড়বে ঠিক তেমনি লেনদেন আরও স্বচ্ছ ও সহজতর হবে। ফলে এগিয়ে যাবে দেশ, বৃদ্ধি পাবে আমাদের জীবনমান।



কম্পিউটারে একটি সফটওয়ার ইন্সটল করার জন্য যেমন প্রিরিকুইজিট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় ঠিক তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার জন্যও কিছু প্রিরিকুইজিট আছে। যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধকরন, সর্বত্র ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ, ডিজিটাল ডেটা উৎপাদন সক্ষম কর্মক্ষেত্র, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আইনি অবকাঠামো এবং সর্বপরি ডিজিটাল উপস্থিতি বৃদ্ধিকরণ। সরকারের স্থিতিশীলতা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতীতির উপর নির্ভর করে ক্রমশ প্রিরিকুইজিট পূরণ হতে চলেছে আর আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চলেছিল টার্গেটবিহীনভাবে। একটা সুনির্দিষ্ট টার্গেট সেট করাই আমি মনে করি বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা। স্মার্ট বাংলাদেশের যে টার্গেট সেট করা হয়েছে একটু কঠিন হলেও একদিন ঠিকই বন্দরে প্রবেশ করবে বলে আশা রাখছি।


লেখক: সহকারী গ্রন্থাগারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার


বিবার্তা/কেআর


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com